হিজল বনের জোনাকি – মাহরীন ফেরদৌস
সমুদ্রের উথালপাথাল ঢেউয়ের মত যখন এক ঝলক বাতাস এসে মাহতাবকে স্পর্শ করে তখন ওর ছেলেবেলার কথা খুব মনে পড়ে। দেশের মধ্যাঞ্চলের যে গ্রামে ওর শৈশব কেটেছিল সেখানে বেলা অবেলায় থেকে থেকে তুমুল বাতাস এসে গা ছুঁয়ে দিত। স্কুল শেষে বন্ধুদের সাথে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর মরে গিয়ে বিকেল জেগে উঠত। সেই সব বিকেলে খেলার মাঠ আর সবুজ ধানক্ষেত এর পাশ দিয়ে আসতে হত। মাঠের পাশেই সারি সারি নারিকেল গাছ প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে বাতাসের তালে তালে মাথা নাড়ানো দেখে মনে হত সবাই সমস্বরে গান গাইছে। এমন মোলায়েম বাতাসে যে কারও নেশা ধরে যেতে বাধ্য। তাই মাহতাবেরও কেমন যেন ঘুম ঘুম লাগত। সেই ঘুম ভাব নিয়ে অনেকটুকু সময় কাটিয়ে ফেলা সম্ভব। সন্ধ্যাবেলা বাইরের ঘরে সুর করে পড়া মুখস্ত করার সময়ও ওর সেই ঘুম ঘুম ভাব কমত না। বরং ঢুলু ঢুলু চোখে হারিকেনের মিটমিটে আলোতে বই পড়তে গিয়ে মনে হত চারপাশে না জানি কোন অপার্থিব জগত তৈরি হয়েছে।
গাজীখালি, ধলেশ্বরী, কালিগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা গ্রামটি কিংবা মাহতাবের জন্মস্থানটি আসলে তেমন বড় কিছু ছিল না। দেশের অন্যান্য সব জেলার মত চারপাশে ঘন সবুজের সমারোহ, আর শীতকালে গনগনে আগুনের মত সর্ষেক্ষেত, ধলেশ্বরীর রুপালি বেলাভূমিতে ভোরের আকাশের আরাম আরাম সূর্য বাদে দেখার মত আর কিছুই ছিল না সেখানে। তবে হ্যাঁ, জেলার আনাচে কানাচে নানান রকম গল্প ছিল। অদ্ভুত সব গল্প। যেমন, দাদাজানের কাছ থেকে মাহতাব শুনেছিল এক বিখ্যাত সুফি দরবেশ অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে এখানে এসে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে শুরু করেছিলেন। তাঁর বসতি এবং খানকা-কে কেন্দ্র করেই আরও অনেক মানুষের বসবাস শুরু হয়। তার নাম থেকেই এই গ্রামের নাম দেওয়া হয়। আবার গঞ্জের নামকরা পাগল হিরামিয়া বলত দুর্ধর্ষ এক পাঠান সর্দারের নামে এই জেলার নাম দেওয়া হয়েছিল। সেই পাঠান সর্দারের লুটরাজের কাহিনি সবাই জানত। তার প্রতিপত্তির কারণেই তার নামে এই গ্রামের নাম হয়েছিল। তখন এইসব গল্প শুনে একটু একটু করে বড় হওয়া মাহতাব কখনো ভাবেনি এই ভিটেমাটি ছেড়ে সে অন্য কোথাও যেতে পারে। সপ্তাহে দুইদিন মসজিদে আরবি পড়তে গিয়ে যখন হুজুরের হাতে কাঠের স্কেল দিয়ে বেধড়ক মার খেত তখনো মনে হয় নি অন্য কোন দেশে বা শহরে ওকে চলে যেতে হতে পারে কোনদিন। বরং বৃষ্টির দিনে পানি ভেঙ্গে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে শাপলা কুড়ানোর বেলাকে খুব সুখী সময় মনে হত।
তবে মাহতাবকে চলে আসতে হয়েছিল। রীতিমত তল্পিতল্পা গুটিয়ে। ব্যবসার সুবিধা আর ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে মাহতাবের আব্বা স্কুল শেষ করার বেশ আগেই আম্মাসহ ওকে নিয়ে ঢাকায় বসবাস শুরু করেছিলেন। সেই থেকে শুরু হল সবুজ গ্রামের সাথে কমলা শহরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। হারিয়ে গেল সবুজ গ্রাম। মাহতাব এল অন্য ভুবনে।
এরপর ওর গ্রামে যাওয়া হয়নি বহুবছর। ছোটচাচা, ফুফুরা একে একে ঢাকামুখী হয়ে গেলেন। নানা ব্যস্ততায় মাহতাব ভুলেই গিয়েছিল ওর শিকড় শুরু হয়েছিল কোথাথেকে। হয়ত ও আজীবনের জন্য সব ভুলে যেত যদি ওকে গতবছর আবার গ্রামে না যেতেহত।
কত বছর পর বাড়িতে গিয়েছিল সে? আট বছর? দশ বছর? হিসেব নেই। শুধু মনে আছে, সেবারও শহরের কোলাহল পেরিয়েই এক ঝলক বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়েছিল মাহতাব। বুকের ভেতরের চাপ চাপ কষ্ট দূর করতে চেয়েছিল নিঃশ্বাস নিয়ে। আগে বাড়ি যেতে হলে বাস থেকে নেমে অল্প কিছু পথ রিকশায়, তারপর বাকিটুকু হেঁটে যেতে হত। দিনে দিনে সময় বদলেছে। শহরের আধুনিকতার ছায়ায় ঢাকা পড়তে শুরু করেছে জেলা শহর এবং গ্রামগুলো। তাই এখন বাস স্টপ থেকে রিকশা নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া যায়। আগের মত কষ্ট করতে হয় না। দোকানপাটও বেড়েছে আগের চেয়ে। পাকা রাস্তা, রেডিওর গান, সাইকেল, রিকশা, মোটর সাইকেল আর সিএনজির ভিড় চারপাশে। এসব দেখে দেখে কাঁচামিঠা রোদ গায়ে মাখতে ভালোই লাগে ওর! তবে বোঝা যায়, গ্রামেও আগের চেয়ে সবুজের আধিপত্য কমে এসেছে। অদূরে টঙের দোকানে চায়ের কাপ- ধোয়ার টুং টাং শব্দ হয়। রেডিওতে গান বাজে ‘দোলা দে, দোলা দে রে পাগলা…’। কে বলবে এখানে যারা থাকে তাদের জীবনে কোন দুঃখ, কষ্ট কিংবা বিপদ থাকতে পারে? বাইরে থেকে কতই নিশ্চিন্ত মনে হয় এদের জীবনকে!
মাহতাব কখনও ভাবে নি আব্বা-আম্মাকে ছাড়া আবার তাকে দীর্ঘদিন পর গ্রামের বাড়িতে যেতে হবে। আব্বা তো বেশ ক’বছর আগে স্ট্রোক করেছেন। আম্মার শরীরটাও বেশি একটা ভালো নেই। ছোট চাচার জরুরি তলব না পড়লে সে নিজে হয়ত গ্রাম আসার কথা ভাবত না। চাচা অবশ্য বলেছিলেন ঢাকায় আইনি কাগজগুলো পাঠিয়ে দিবেন সই করার জন্য, কিন্তু মাহতাব তা চায় নি। বরং একের পর এক খবরগুলো শুনে সে অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। তারপর নিজেই বলেছিল, সে সশরীরে মিটিং করতে চায়। আর গ্রামের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ও স্কুল কমিটির সামনে বসে কথা বলে, সই করতে চায়।
এ গ্রাম, পথঘাট, মানুষগুলো ওর এককালে কত আপন ছিল। আহ! ফেলে আসা সময়! কাজীবাড়ি নামে ওদের বাড়িটা একনামে গ্রামের সবাই চিনত। বাড়ির পাশেই মস্ত বড় পুকুর। ভোরবেলা মুখ ধুতে কলতলায় না গিয়ে পুকুরপাড়ে গেলে দেখা যেত চকমকি পাথরের মত শত শত মাছ চকচক করছে পানির উপর। পুকুরপাড়ে বসে মাছদের খলবল খলবল মাতামাতি দেখতে মাহতাবের অনেক ভালো লাগত। আর ভালো লাগত দত্ত স্যারের বাসায় প্রাইভেট পড়তে গিয়ে চিড়ার মোয়া খেতে। সে সময় গ্রামে দত্ত স্যারের মত জ্ঞানী মানুষ আর কেউ ছিল না। একা মানুষ। বিয়ে থা করেন নি। কাছের আত্মীয় স্বজনের প্রায় সবাই বহু আগেই ভারতে চলে গিয়েছেল, শুধু উনি দেশের মায়া ত্যাগ করতে পারেন নি বলে থেকে গিয়েছিলেন। স্কুলে ইংরেজি পড়ানো শেষ করে নিজের বাড়ি ফিরে অল্প কিছু খেয়েই বই পড়তে বসতেন। দেশ বিদেশের কত যে বই ছিল উনার কাছে। বাংলা, ইংরেজি, ফার্সি, সংস্কৃত। পাগলের মত বই পড়তেন তিনি। স্কুলের ক্লাস বাদে কাউকে প্রাইভেট পড়াতে রাজি ছিলেন না তিনি। সব সময় বলতেন কিছু না বুঝলে ক্লাসের পরপরই উনাকে জিজ্ঞেস করে নিতে। সে সময়ে সবাই উনাকে খুব সমীহ করে চলত। হেডস্যার পর্যন্ত উনার যে কোন মতামতকে গুরত্ব দিয়ে দেখতেন। পঞ্চম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণীর ইংরেজি ক্লাস আর স্কুলের যে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য উনার বিকল্প কেউ ছিল না। আর এইসব সুনামের কারণেই মাহতাবের আব্বা-আম্মাসহ আরও অনেকে স্যারের হাত-পা ধরে নিজেদের ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য করেছিল। দত্তস্যারের কাছে ইংরেজি সংক্রান্ত কোন কিছু নিয়ে কোন না কোন প্রয়োজনে আসেনি,এমন মানুষ এলাকায় বলতে গেলে ছিলই না। পাড়ার উকিল থেকে শুরু করে ডাক্তার সবাই আসত। ইংরেজিতে কিছু লিখতে হলে, ঠিক করতে হলে, শিখতে হলে ছেলে বুড়ো সবাই ধর্না দিত তার বাসাতেই। উনার মত ইংরেজিতে এমন দুর্দান্ত দখল আশেপাশের গ্রামেও আর কারো ছিল না। আর সে কারণেই প্রভাবশালী, সচ্ছল সব পরিবারের কর্তারা দত্ত স্যারকে ধরে নিজেদের ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়ানোর ব্যবস্থা করেছিল যাতে তাদের ছেলে মেয়েরাও খুব ইংলিশ বাবু, ইংলিশ মেম হতে পারে।
গ্রামে মোট দুইটা মসজিদ ছিল। মাটির মসজিদ আর বড় মসজিদ। বড় মসজিদ ছিল বিশাল। অনেক বড় জায়গা নিয়ে করা। সেই মসজিদের উলটা দিকের পথেই ছিল দুইটি ঘর নিয়ে বাংলাঘরের মত ছোট্ট বাড়ি। মাহতাবের দাদার আমলে সেখানে গ্রামের জরুরি বৈঠকগুলো হত। বিচার হত। দাদাজানের মৃত্যুর পর সেই ঘর দুটায় আর কিছুই করা হয় নি। দত্ত স্যারকে প্রাইভেট পড়ানোর জন্য সেই ঘর দুটা নামমাত্র ভাড়ায় দিয়ে দিলেন মাহতাবের আব্বা। তবে সত্যি বলতে সময়ের সাথে সাথে এরপর অনেকেই ভুলে গিয়েছিল ঘর দু’খানা যে কাজী বাড়ির সম্পত্তি ছিল। ‘দত্ত স্যারের ক্লাসরুম’ নামেই পরিচিতি পেয়ে গিয়েছিল বাড়িটা। উনি নিজেও আগের ভাড়া বাসাটা ছেড়ে দিয়ে এই বাড়িতেই থাকা শুরু করেছিলেন।
সেই সব দিনগুলোতে শীতের সকালে কাঁপতে কাঁপতে দত্ত স্যারের ক্লাসরুমে গেলেই উনি নানা ইংরেজি শব্দ মুখস্থ করতে বসিয়ে দিতেন। পড়া পারলে পাওয়া যেত ছোট্ট ছোট্ট চিড়ার মোয়া। কালো মোটা ফ্রেমের আড়ালে উনার বড় বড় চোখ দিয়ে উনি দেখতেন কে কেমন মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। ঠিকমত না পড়লেই শাস্তি হিসেবে ইংরেজি হোমওয়ার্কের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম আর সুকান্তের কবিতা মুখস্থ করতে দিতেন।
এছাড়াও প্রতি মাসের দুই শুক্রবারে বিকেলের ব্যাচ পড়িয়ে শেষ করার পর সেখানে গানের আসর বসত। ডালিয়া, আফরিন, শাপলা, রকিব, রাসেল, হালিম সবাই মিলে কোরাসে গান গাইত। কলেজ পড়ুয়া, সুকণ্ঠি মিতা আপা হারমোনিয়াম নিয়ে বসতেন সবার সাথে। যে কেউ সেই বিকেলগুলোতে অনেক দূর থেকে হেঁটে গেলেও শুনতে পেত একদল ছেলেমেয়ে সুরে, বেসুরে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে গান গাইছে।
মাহতাব একবার স্কুল ফাঁকি দিয়ে হালিম আর রাসেলের সাথে সাইকেলে করে পাশের গ্রামে পূজা দেখতে গিয়েছিল। তিনজন মানুষ, দু’টা সাইকেল। রাসেল ছিল বেশ হালকা পাতলা। মাহতাবের সাইকেলে সহজেই তাই দু’জনের জায়গা হয়ে যেত। মুক্ত আর উদ্ভ্রান্ত ঘুড়ির মত ছুটেছিল ওরা। স্কুল পালানো আর সবাইকে ফাঁকি দেওয়ার তীব্র আনন্দ ও অভিজ্ঞতা ছিল সেবারই প্রথম। যেন আলিফ লায়লার মায়ানগরীর পথে ছুটে যাচ্ছে ওরা। ভেবেছিল দুপুরের মাঝেই ফিরে আসবে। কিন্তু তার আগেই আকাশ কালো করে মেঘ জমল। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হল আকাশ ফুটো হওয়া ডাকাতে বৃষ্টি। মাহতাবরা আটকা পড়ে গেল মেলার রাস্তার। কোনক্রমে সাইকেল নিয়ে আশ্রয় নিল সবচেয়ে বড় মন্দিরের ভেতরে। তারপর তিনজন গুটিসুটি হয়ে বসে গলা বাড়িয়ে তুমুল বৃষ্টি দেখতে থাকল।
ক্ষণিকের জন্য তিনজনেই ভুলে গিয়েছিল সকাল থেকে কতগুলো মিথ্যে বলে এসেছিল। তবে অল্পক্ষণের ব্যবধানেই মনে পড়ে গিয়েছিল ওদের সবকিছু। হালিমের বাবার মুদি দোকান ছিল। স্কুলের পর হালিম সেখানে নানা কাজে সাহায্য করত। হালিম ভাবল, বৃষ্টির জন্য দেরি হলে, নিশ্চয়ই তিনি হন্যে হয়ে হালিমকে খুঁজতে থাকবেন, এবং না পেলে বাড়ি যাওয়ার পর তেরটা বাজাবেন।
রাসেলের বাবা মারা গিয়েছিল বহু আগেই, কিন্তু ওর মা ছিল অসম্ভব বদমেজাজি। কারণে অকারণে অনেকবার রাসেলের পিঠে ডাল ঘুটনি ভাঙতে দেখেছে পাড়া প্রতিবেশী। ওর বাসার ডাল ঘুটনি ডালের পাতিলে কম আর ওর পিঠেই বেশি পড়ত। রাসেল মনে মনে কল্পনা করেনিল, আজকে হয়ত তার পিঠে দু’টা ডাল ঘুটনি ভাঙ্গা হবে।
আর মাহতাবের বাবার মেজাজের কথা কে না জানে? ওর মা ওকে বাঁচানোর হাজার চেষ্টা করলেও স্কুল পালানোর কথা শুনলে আব্বা আসলেই আস্ত রাখবে না ওকে। এ নিয়ে ও শতভাগ নিশ্চিত।
এইসব ভেবে ভেবে ওরা তিনজনই ডাঙায় উঠে আসা মাছের মত ভেতরে ভেতরে তড়পাচ্ছিল। টানা বৃষ্টির কারণে পূজার মেলা ভেস্তে গিয়েছিল বেশ আগেই। এরপর রাস্তায় পানি জমতে থাকল। ঘণ্টাখানের মাঝে পানি থই থই করতে থাকল। এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল শুরু হয়ে গিয়েছে। বাড়িতে কী বিপদ ঘটে গিয়েছে তা নিয়ে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে ওরা সেই পানির মধ্যেই সাইকেল নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিল। হালিমের পকেটে পূজার মেলা থেকে কেনা এক প্যাকেট চালতার আচার ছিল।যার অল্প একটুই সে খেতে পেরেছিল। বৃষ্টির জন্য সেই আচার পকেটের সাথে পিচ্ছল হয়ে লেগেছিল। আর তাই ওর সাদা শার্টের পকেট আচারের রঙে খয়েরি হয়ে গিয়েছিল। কী অদ্ভুতই না লাগছিল ওকে দেখতে।
আগের চেয়ে বৃষ্টি তুলনামূলকভাবে ধরে এসেছিল। তবে রাস্তার পানির মধ্যে সাইকেল চালানো সম্ভব ছিল না। ওরা তিনজন তাই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সাইকেল ঠেলে নিয়ে আসছিল। লম্বা পথ হাঁটতে হয়েছিল ওদের। পথটুকু দ্রুত শেষ করার জন্য আসার পথে রেল লাইনের কন্ধকাটা ভুত, কিংবা পুরানো কুয়ার ভেতর থেকে উঠে আসা সাতশ জীনের গল্প শুনিয়েছিল রাসেল। গা ছম ছম করা গল্প শুনতে শুনতে ওরা যখন নিজেদের এলাকায় কাছে পৌঁছেছে তখন সন্ধ্যা নামি নামি করছে। বৃষ্টি কমে আসলেও মেঘ কমেনি। আর এদিকে স্কুল পালানোর খবর ছেয়ে গিয়েছে চারপাশে। বাড়ি ফেরার পর তিনজনেই বেধড়ক ধোলাই খেয়েছিল। রাসেলের আম্মা তো মারতে মারতে ওর ঠোঁটই ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর সন্ধ্যাবেলা হেডস্যারের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওদের তিনজনকে। একই দিনে দ্বিতীয়বারের মত ধোলাই খাওয়ার মত অবস্থা আসলে কারোই ছিল না। তবুও ভয়ে ভয়ে হাজির হতে হয়েছিল হেডস্যারের বাসার উঠানে। রাসেলের ঠোঁটের রক্ত চুইয়ে পড়েছিল ওর শার্টে। ভয়াবহ লাগছিল ওকে দেখতে। হেডস্যারের প্রায় মিনিট দশেকের বকা আর আধ ঘন্টা কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকার পর সন্ধ্যার আলোছায়া ঘেরা উঠানে একটা দীর্ঘ ছায়া দেখা গেল। হ্যাজাকের আলোর জন্য ছায়াটা এক জায়গায় খুব বেশি স্থায়ী হল না, চঞ্চল হয়ে বাড়তে শুরু করে দিল। বাড়তে বাড়তে একদম সামনে চলে এলো। মাহতাবরা তখন মনে মনে আল্লাহ্র কাছে সাহায্য চাইছে। আর ভাবছে, না জানি আবার কোন শাস্তি পেতে হবে দত্ত স্যারের কাছে। তিনজনই যখন মনে মনে প্রমাদ গুনছে তখনই সেই দীর্ঘ ছায়ার মানুষটি পাতলা চাদর গায়ে দিয়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সামনে যেয়ে হুংকার দিয়ে বললেন,
– বদের হাড্ডিগুলো, তোরা দেখছি ঠিকমত স্কুল পালাতেও শিখিস নি। প্রথমদিনেই কেউ এভাবে নাজেহাল হয়ে ধরা পড়ে? যা, এখুনি বাসায় যা। এরপর খাবার খেয়ে কাঁথার নিচে ঢুকে পড়া মুখস্থ করা শুরু কর। বৃষ্টির মধ্যে এত ভিজেছিস পরীক্ষার আগে আগে সবগুলো নিওমোনিয়া বাঁধাবি দেখছি।
– বাড়ি চলে যাব স্যার? প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বলেছিল মাহতাব।
– হ্যাঁ, আর নয়ত কোথায় যাবি? সোজা বাড়ির পথে যা। আর বাসায় আবার কেউ মারধোর করলে আমাকে বলবি। এক দিনে ডোজ বেশি হয়ে যাচ্ছে।
– চলে যাব স্যার?
– যাওয়ার আগে হেড-স্যারের কাছে মাফ চা। বল আর এমন করবি না। এরপর ঝেড়ে সবগুলো দৌড় দে।
– আচ্ছা, মাফ করে দেন স্যার।
– যাচ্ছি।
– গেলাম।
– আর এমন হবে না, বলেই ওরা তিন জন রূদ্ধশ্বাসে উঠান ছেড়ে পালিয়েছিল।
সেদিনের পর ওরা আরও অনেক স্কুল পালালেও ধরা পড়ে নি। তবে আর যাই হোক দত্ত স্যারের কোন ক্লাস সে বছর আর মিস দেয় নি। একটা দিনের জন্যও না।
এখন রাসেল আর হালিম কোথায় আছে, কে জানে? দীর্ঘদিন ওদের সাথে কোন যোগাযোগ নেই। বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় স্থায়ী হওয়াতে পেছনে পড়ে গিয়েছে আগের সবকিছু। আসলে ঢাকার জীবনে হাওয়া বদলের সাথে বদলে যায় অনেক কিছুই। শহুরে জীবনে একটা নিষিদ্ধ টান আছে, একবার কেউ এখানে আসলে সে আর পেছনে ফিরে যেতে কিংবা তাকাতে চায় না। এরপরও মাঝে মধ্যে মাহতাব ছুটি-ছাটায় বাড়িতে গিয়েছিল। তবে খুবই অল্প সময়ের জন্য। কয়েকবছর আগে শুনেছিল দত্ত-স্যারের ক্লাসরুমের সংখ্যা বেড়েছে। দুই থেকে হয়েছে তিন। তবে তিনি আর প্রাইভেট পড়ান না। শুধুই স্কুলে ক্লাস নেন। আর মঙ্গল, শুক্র শনিবার প্রাইভেট পড়ানোর ঘরে এখন ছবি আঁকা, গান শিখা আর নাচের ক্লাস হয়। তিনজন শিক্ষক নিয়েছেন উনি ছেলে-মেয়েদের শিল্প চর্চা করানোর জন্য। তাদের মধ্যে একজন নাকি প্রতি সপ্তাহে ঢাকা থেকে গ্রামে গিয়ে ক্লাস নিয়ে আসে। মাহতাব এ খবর শুনে মনে মনে ভেবেছিল দত্ত স্যারের ধৈর্য্য আছে বটে। এরপর বহুদিন আর কিছু জানার প্রয়োজন হয় নি মাহতাবের কিংবা ওর পরিবারের কারও। হয়ত জানার প্রয়োজন পড়তই না যদি সেই ঘটনাটি না ঘটত। যে কারণে বহু বছর পর মাহতাবকে আবার গ্রামে যেতে হয়েছিল।
আশ্বিন মাসের কোন এক রাত। এলাকার সবাই সেদিন সনি চ্যানেলের সিরিয়াল দেখে গাঢ় ঘুম দিতে গিয়েছিল। কয়েকজন হয়ত জেগেও ছিল। অনেক রাতে বড় মসজিদের উল্টা পাশের ক্লাসরুমের থেকে একটু দূরে বেশ বড় একটা গাড়ি থেমেছিল। তারপর অন্ধকারে অশরীরীর চলাফেরার মত কিছু ছায়ামানব নেমে এসেছিল গাড়ি থেকে। তারা কোথায় গিয়েছিল কেউ দেখে নি। জানে নি। শুধু হঠাৎ একটা গগনভেদী আর্তনাদ অন্ধকার চিড়ে ফেলেছিল। সেই আর্তনাদে অনেকের ঘুম ভাঙ্গে নি। সারাদিন গতর খাটিয়ে রাতে পেটপুরে খেয়ে সুখঘুম দিলে কারই বা সহজে ঘুম ভাঙ্গে? আর কয়েকজনের যা-ও বা ঘুম ভেঙ্গেছিল তারা সশব্দে বাড়ির সব জানালা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে বসেছিল। ভেবেছিল হয়ত পাড়ায় ডাকাত পড়েছে। কিছু ধুপধাপ শব্দ, কিছু অচেনা কণ্ঠস্বর আসা-যাওয়া করেছিল চারপাশে। এরপর সেই বড় গাড়ির হেডলাইটের আলো ফিকে হতে হতে অন্ধকারে এমন করে মিলিয়ে গিয়েছিল যেন কিছুই হয় নি। সেই রাতে বাড়ি থেকে ভয়ে কেউ বের হয় নি। যদি সেই ডাকাতেরা আশাপাশেই থাকে এই ভেবে।
খুব ভোরে মানুষজন খুঁজতে শুরু করেছিল আগের রাতের ঘটনার অস্তিত্ব। খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল ততক্ষণে পুলিশের গাড়ি চলে এসেছে, একে একে আসছে সাংবাদিকদের দল। মসজিদের উলটা পাশের বাড়িতে ভিড় জমে উঠল গ্রামবাসীর। না, আগের রাতে কোথাও ডাকাতি হয় নি। কেউ হারিয়ে যায়নি। কিছু খোয়া যায় নি। শুধু কে বা কারা এসে দত্ত স্যারকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে রেখে গিয়েছে। তিনঘরের মেলবন্ধনের ক্লাসরুমে যে ছবি আঁকার ঘরটা ছিল সেটার সাদা দেয়ালটাই আস্ত একটা ক্যানভাস হয়ে গিয়েছে। সেখানে লেগে আছে থোকা থোকা, ছোপ ছোপ কালচে রক্ত। আর ঘরের মেঝেতে পড়ে থেকেছে একটা মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। যার কাচদুটা ভেঙ্গে চৌচির। দেখে মনে হবে, যেন কারও দীপ্তময় চোখদ্বয় নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
সারা গ্রামের সবাই সেই দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিল, বলাবলি শুরু করেছিল এত ভালো মানুষটার এই হাল কে করল? কেন করল? অনেকে চোখ ভিজিয়ে কাঁদল। অনেকে নামাজে দত্ত স্যারের জন্য দোয়া করল। এই ঘটনার ঠিক দু’দিন পরে কে বা কারা যেন বাতাসে ছড়িয়ে দিল, মসজিদের উলটা পাশে গান, বাজনার মত জাহান্নামী কাজ করত দত্ত স্যার। শুক্রবার জুমআর নামজের খুতবা শেষ হবার পর পরই ছেলে পিলেরা, ভালো ঘরের মেয়েরা নাচ, গান শুরু করতে ক্লাসে চলে যেত। এইসব হিন্দুয়ানী শয়তানি কাজ এই গ্রামে আর কতদিন কেউ সহ্য করবে! এইসব মালাউনের পুতের জন্যই তো গ্রামের পাপ বাড়ছে। আর যেই লোক বিয়ে করে নি, সংসার করে নি তার কাছে নিজেদের কচি কচি মেয়েদের পাঠানো কি ঠিক হয়েছিল? তাই এবার তার বিচার হল। প্রথম প্রথম এই কথাগুলো শুনে গ্রামের সবাই আতংকিত হয়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ মৃদু প্রতিবাদ করার কথাও হয়ত ভেবেছিল। কিন্তু কিছুদিন পর তারাই আবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কারণ, তাদের পরিবার ও সন্তানদের তো আর কিছু হয় নি। আর ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করবে বড় চাকরি পাওয়ার জন্য। টাকা উপার্যনের জন্য। এইসব গান-বাজনা, নাচানাচিতে তাদের কী বা উপকার হত? দত্ত স্যারকে তারা ইংরেজি পড়াতে বলেছিল। গানবাজনা করতে নয়। তার সাথে যা হয়েছে সেটা হয়ত খুব সঠিক কিছু নয়, তবে তিনি যা শুরু করেছিলেন সেটাও ঠিক কিছু ছিল না। তার ওপর মসজিদের আশেপাশের জায়গা হলে তো আরও নয়। কথিত আছে – এ গ্রামের লোকেরা পুঁটি মাছ ধরলে বলে‘বোয়াল মাছ ধরছি’। তাই ধারণা করে নেওয়া যায়, দত্ত স্যারের চরিত্র ও মৃত্যু কতটা ভুলভাবে ডালপালা ছড়াতে পারে আশেপাশে। অবশ্য গঞ্জের সেই বিখ্যাত পাগল হিরামিয়া থাকলে সে নিশ্চয়ই অন্য কোন ব্যাখ্যা দিয়ে সবাইকে খুনের ঘটনা বলত। তবে সে মারা গিয়েছে বেশ আগেই। তার আশা করে আর লাভ নেই।
এইসব অতীত ভাবতে ভাবতে কখন জানি মাহতাবের হাতের সিগারেট নিভে যায়। বেশ অনেকটা আগে আনমনা হয়ে ধরিয়েছিল সিগারেটটা।আবার আগুন ধরায়। উত্তুরে বাতাসে একটু যেন শীত শীত লাগছে তার। লম্বা টান দেয় সে। সিগারেট পুড়ে যেতে থাকে একটু একটু করে। তার আর শৈশবে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। বর্তমান নিয়েও ভাবতে ইচ্ছে করে না। সেবার সে গ্রামে গিয়েছিল ‘দত্ত স্যারের ক্লাসরুম’ এর আইনি কাগজপত্র সই করতে। কাজী পরিবারের পক্ষ থেকে সেই বাড়িটিকে এলাকার লাইব্রেরী বানানো হবে। কতদিন টিকবে, কয়জন বই পড়বে, বা আদৌ কেউ পড়বে কিনা তা মাহতাব জানে না। আবার কোন মধ্যরাতে এই লাইব্রেরীতে কেউ এসে আগুন দিয়ে সব পুড়িয়ে যাবে কিনা তাও সে জানে না। শুধু সে জানে তার শৈশবের প্রিয় স্মৃতিতে সে একটা মশাল জ্বালিয়ে এসেছে। সেই আলোতে ওখানের মানুষগুলো আলোকিত হবে কি হবে না এটা একান্তই তাদের ব্যাপার। সে এটা নিয়ে আর কিছুই ভাবতে চায় না।
তারচেয়ে কোন রোদেলা দিনের এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাসের মত দত্ত স্যার বেঁচে থাকুক। শীতের সকালে মোয়া খাওয়া আর এক মেঘলা সন্ধ্যায় দীর্ঘ ছায়ার হুংকারের গল্প বেঁচে থাকুক। শুক্রবার বিকেলের ক্যানভাসে তুলির আঁচড়, নূপুরের নিক্বণ আর গানের কোরাস বেঁচে থাকুক। শুধু তিনি জানলেন না যে রবীন্দ্রনাথ ও সুকান্ত পড়া সেই পাড়াগাঁয়ের বালক ছেলেটি এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। ইংরেজিতে সে অনেক অনেক পাকা। একদম সাহেবদের মত। আর এতগুলো বছরে সে নানান দেশের গল্প কবিতা পড়ে ফেলেছে। এখনও পড়ছে। মাঝে মাঝে যা মনে আসছে তা লিখছেও। তাই ভেবে নেওয়া যাক দত্ত স্যারকে সৃজনশীলও সংস্কৃতমনা হবার কারণে কেউ কুপিয়ে মেরে ফেলেনি। বরং ফ্রান্ৎস কাফকার পোকার গল্পের মত দত্ত স্যার মানুষ থেকে একটা জোনাকি পোকায় পরিণত হয়েছেন এবং কোন এক হিজলবনের গাঢ় অন্ধকারে আলো ছড়াচ্ছেন।
আর শৈশবে ফিরে যেতে না চাওয়া মাহতাব বাতাসে বাতাসে স্যারের গায়ের ঘ্রাণটুকু খুঁজে বেড়াচ্ছে আজও।