মহাভারতের কৃষ্ণায়ণ এবং রামের বৈষ্ণবায়ন – মাহবুব লীলেন
জনপ্রিয় ধারণায় রাম-রামায়ণ-বাল্মিকীরে কৃষ্ণ-মহাভারত-দ্বৈপায়ন থাইকা প্রাচীন ভাবা হইলেও ঘটনা কিন্তু ঠিক উল্টা। এর পক্ষে পয়লা জোরালো যুক্তিটা হইল দক্ষিণ দিকে আর্যগো ভারত-বিস্তারের কালক্রমের লগে দখলি-মানচিত্রের হিসাব। মহাভারতের ঘটনাস্থল থাইকা রামায়ণ ঘটনাস্থল আরো বহুত পূর্ব দিকে। আর্যগো দক্ষিণ দিকে পা বাড়াইবার ঐতিহাসিক সময়কাল মাথায় রাইখা রমিলা থাপারও মন্তব্য করেন যে রামায়ণ তৈরি হইছে ৮০০খিপূর অন্তত পঞ্চাশ থাইকা একশো বছর পরে। মানে সাড়ে সাত থাইকা সাতশো খিপূর দিকে…
রমিলা থাপারের এই যুক্তিটা অতুল সুরও সমর্থন করেন। আর্য-যাত্রার সময়কালের লগে আর্যগো ভূগোল-পরিক্রমা নিয়া যারা কাজ করেন তাগো প্রায় সকলেরই হিসাব নিকাশ প্রায় এক। সকলেই মোটামুটি একমত যে কুরু-পাঞ্চাল এলাকাই হইল পয়লাবারের মতো আর্যগো সাম্রাজ্য স্থাপনের নিদর্শন; যেইখান থাইকা অযোধ্যা কিংবা কোশলের মতো দক্ষিণের ভূমি পর্যন্ত পৌছাইতে আর্যগো সময় লাগছে আরো কয়েক শো থাইকা হাজার বছর…
বাল্মিকীরে রামায়ণের সক্রিয় চরিত্র ধইরা রামায়ণ বিচার করতে গেলে রামায়ণের প্রাচীনত্ব কইমা আসে আরো কয়েকশো বছর। কারণ ঐতিহাসিকভাবে ধরা হয় বাল্মিকী খিপূ পাঁচ থাইকা চাইর শতাব্দির মানুষ।
এমন কি বিপ্লব মাজীর মতো কেউ কেউ কন যে সংস্কৃতে রামকথার সব থিকা প্রাচীন নিদর্শন ভট্টিকাব্য এবং বাল্মিকীর রামায়ণ রচনার আগেই কালিদাস তার রঘুবংশ লিখা ফালাইছিলেন। মানে বাল্মিকী কালিদাসেরও পরের মানুষ। রামায়ণে বাল্মিকীর উপস্থিতি সঠিক ধইরা নিতে গেলে তার পোলার বয়েসি রামের বয়সও কইমা আসে আরো বেশ কিছু। আর রামেরে অবতার ধরতে গেলে সেই হিসাবটা চইলা আসে আরো বহু বহু কাছে; বৌদ্ধ বিপ্লবের পরে আর খ্রিস্ট জন্মের সামান্য কিছু আগে। কারণ ধর্মের উৎস সন্ধানে বইয়ে ভবানীপ্রসাদ সাহু কন রামেরে অবতার হিসাবে পরিচিত করানো হইছে আর্যগো দক্ষিণ দিকের যাত্রার সময়; গুপ্ত যুগে…
অন্যদিকে মহাভারতের পাণ্ডবগো সপ্তম পুরুষের রাজত্বকালীন হস্তিনাপুরের কিছু নিদর্শনের বয়স মোটামুটি নির্ধারিত হইছে খিপূ ৮০০’র মতো। এইটারে ধইরা রমিলা থাপার তার ভারতবর্ষের ইতিহাস পুস্তকে কুরুযুদ্ধের সময় নির্ধারণ করেন ৯০০খিপূ। বেশিরভাগের হিসাবে মহাভারত কমবেশি এক হাজার খিপূ সালের ঘটনা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হিসাবে কুরুযুদ্ধ হইছে ১৪৩০খিপূ সালে। অতুল সুর তার মহাভারত ও সিন্ধু সভ্যতা পুস্তকে বিশ্লেষণ কইরা দেখান যে প্রাচীন দুই গণিতবিদ আর্য ভট্ট আর বরাহ মিহিরের গণনায় যুধিষ্ঠিরের রাজ্য অভিষেকের সময় গিয়া খাড়ায় ২৪৪৮ খিপূ সাল। আর্যভট্ট-বরাহ মিহির কুরুযুদ্ধ নিয়া কিছু কন নাই আর সাক্ষী প্রমাণের অভাবে অতুল সুর কুরুযুদ্ধের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। কুরুযুদ্ধ বিশ্বাসীরা চাইলে এই তারিখ থাইকা তিরিশ বচ্ছর বিয়োগ দিয়া কুরুযুদ্ধের সাল বাইর কইরা নিতে পারেন…
এর বাইরে জনপ্রিয় প্রচলিত ধারণামতে মহাভারতের সময়কাল ৩১০০খিপূর কাছাকাছি। কিন্তু আর্যভট্ট-বরাহ মিহিরদের হিসাব কিংবা মহাভারতের আরো প্রাচীনত্বের দাবি মানতে গেলে আরেকটা বিকট ঝামেলায় পড়তে হয়।
সেই ক্ষেত্রে মাইনা নিতে হয় যে মহাভারতের ঘটনা ঘটছে ভারতবর্ষে আর্যগো আগমন এবং ঋগবেদ তৈরির দেড় দুই হাজার বচ্ছর আগেই। সেইটা মানার যুক্তি আছে বইলা মনে হয় না। কারণ মহাভারতের চরিত্রগুলারে অন্তত প্রাক-আর্য হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর মানুষ ভাবা প্রায় অসম্ভব…
ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম দিকে ঢোকা ইরানি মানুষ বা আর্যগো পয়লা দলের যে আগমন ক্যালেন্ডার পাওয়া যায় তা সর্বোচ্চ ১৫০০ খিপূ সাল। ঘোড়ায় চইড়া প্রথমে আফগানিস্তানে ঢোকা এই ইরানিরাই নিজেগো আদিভূমি থাইকা স্মৃতিতে নিয়া আসছিল ঋগবেদের কিছু শ্লোক। পরে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে পাঞ্জাবে থিতু হইয়া আদিভূমির স্মৃতির লগে পাঞ্জাববাসের অভিজ্ঞতা মিলাইয়া মোটামুটি ঋগবেদরে একটা সাইজে নিয়া আসে; যদিও ঋগবেদ রচনা চলতে থাকে আরো প্রায় হাজারখানেক বছর। মোটামুটি আর্যগো সারা ভারত জয়কালীন পর্যন্ত চলতে থাকে ঋগবেদের সংযোজন পরিবর্ধন। এবং এর লগে লগেই তৈয়ারি হয় আরো দুইখানা কিংবা মতান্তরে তিনখান বেদ…
ভারতে আর্যগো আগমনকালের দিকে তাকাইয়া একটা জিনিস অন্তত নিশ্চিত কইরা বলা যায় যে খিপূ ১৫০০ সালের আগে ভারতবর্ষে বৈদিক কিংবা ইরানি-আর্যভাষাগোষ্ঠী সম্পৃক্ত কোনো ঘটনার কোনো অস্তিত্ব নাই; শাস্ত্রও না; ভগবানও না; রাজা-বাদশা-ঋষি-কবি-যুদ্ধ এইগুলা তো বহুত বহুত দূর। এর আগের বইলা যা কিছু দাবি করা হয় তা সবই মূলত সময় গুণতে না পারা ধর্মবিশ্বাস কিংবা লোকায়ত সাহিত্য…
এই হিসাবে মহাভারত ঘটনার বয়স সংক্রান্ত বঙ্কিমচন্দ্রের হিসাবটাও বাতিল না কইরা উপায় থাকে না। কারণ আর্যগো আগমন কাল থাইকা বঙ্কিমচন্দ্রের হিসাবে কুরুযুদ্ধকালের ব্যবধান সত্তুর বছর। আর হিসাবমতে কুরুযুদ্ধকালে যুধিষ্ঠিরসহ প্রায় সকলের বয়স আছিল কমপক্ষে ষাইটের কাছাকাছি কিংবা বেশি। এই ক্ষেত্রে বঙ্কিমের হিসাব মাইনা নিতে গেলে ধইরা নিতে হইব যে বিদুর পাণ্ডু- ধৃতরাষ্ট্র এদের সকলেরই জন্ম হইছে ভারতে আর্যগো আগমনের আগেই; অন্য কোথাও। তাছাড়া ঋগ্বেদরে যারা অনেক প্রাচীন কইতে চান তারা কন এইটা তৈরি হইছে খিপূ ১৩০০-তে আর যারা এরে আরো নবীন বলেন তারা কন ১২০০ খিপূ; মানে বঙ্কিমচন্দ্রের হিসাবে কুরুযুদ্ধের কমপক্ষে ১৩০ কিংবা ২৩০ বছর পরে…
মহাভারতরে ঋগবেদের আগের ঘটনা ভাবা কঠিন। কারণ ঋগবেদ যেখানে বেশ ভালো কইরাই আর্যগো ছোটখাটো ঘটনাবলীর ডায়েরি কইরা গেছে সেইখানে কিন্তু মহাভারত ঘটনার কিছুই নাই। আবার এইটাও সইত্য যে মহাভারত কাহিনিতে কিন্তু কিছু বৈদিক দেবতার অগোছালো উপস্থিতি ছাড়া বৈদিক সিস্টেমের প্রভাব প্রায় কিছুই নাই। আবার মহাভারতে বৈদিক দেবতাগো যে উপস্থিতি; তাতে এইটারে বৈদিক দেবতাগো দাপটের কাল না কইয়া পতনকালের সাক্ষী হিসাবেই ধরবার যুক্তি বেশি মনে হয়। সেইখানে সূর্য আইসা কিশোরী কুন্তীর খেলায় সঙ্গ দেন; অগ্নী আইসা ভিক্ষা করেন কৃষ্ণ-অর্জুনের কাছে। দেবরাজ ইন্দ্র অর্জুনের কাছে মাইর খাইয়া পরে কুরুযুদ্ধে অর্জুনের ফুটফরমাস খাটেন। অথচ অন্যদিকে পাণ্ডবপক্ষের অর্জুন কিংবা কুরুপক্ষের অশ্বত্থামা কারোপক্ষেই কার্যকর বীরত্ব দেখানো সম্ভব হয় না বৈদিক সমাজে আত্মীকৃত নতুন অনার্য দেবতা শিবের আশীর্বাদ ছাড়া…
অবশ্য হিসাব মতে মহাভারতে বৈদিক দেবতার উপস্থিতি; মানে কুন্তীরে গর্ভবতী করা থাইকা কর্ণের অক্ষয় কবচ চুরি আর অবৈদিক দেবতা শিবের ভূমিকা; মানে দ্রৌপদীরে পাঁচ স্বামী দান করা থাইকা পাঁচ পোলা হত্যায় ইন্ধন দেয়া; দুইটার কোনোটাই আদি মহাভারতের অংশ না। দুই ধরনের দেবতার উপস্থিতিই পরবর্তীকালের ইনজেকশন। কিন্তু ইনজেকশনের ধরন দেইখাই সেইখানে বৈদিক দেবতাগো পতনকাল আর শিবের উত্থানকালের নিদর্শন কিন্তু অনুমান করা যায়…
আবার অন্যদিকে দ্বৈপায়নের মতো অনার্যগর্ভজাত এক ঋষি ছাড়া পুরা মহাভারত কিন্তু সম্পূর্ণভাবে সাধারণ ব্রাহ্মণগো দাপটমুক্ত আখ্যান। তবে দ্বৈপায়নের সম্মান সেইখানে ঋষি হিসাবে নাকি কুরু-পাণ্ডবের পিতামহ হিসাবে সম্মানিত সেইটা কিন্তু বিতর্কের বিষয়…
সাধারণভাবে ব্রাহ্মণসেবা বা বামুন বন্দনা বলতে যা বোঝায় তার অস্তিত্ব মহাভারতে নাই। মহাভারতে পুরোহিত বামুনগো এক্কেবারে নীচু স্তরের রাজকর্মচারী ছাড়া অন্যকিছু ভাবা কঠিন। সম্রাট ধৃতরাষ্ট্রের পুরোহিত কৃপাচার্য শান্তনু পরিবারে পালিত এক না খাওয়া ঘরের সন্তান। ধৃতরাষ্ট্রের দূত সূতপুত্র সঞ্জয়রে আমরা সম্রাটের লগে যতটা বড়ো গলায় কথা কইতে দেখি কৃপাচার্যরে তার কণামাত্র দেখি না। তিনি আগাগোড়া তলুয়া হিসাবেই আচরণ করেন। যুধিষ্ঠিরের পুরোহিত ধৌম্যরে পাণ্ডবগো পিছে পিছে ঘটিধরা মানুষ ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নাই…
মহাভারতে আরেকজন রাজকীয় পুরোহিতের দেখা পাই; পাঞ্চাল রাজ দ্রুপদের পুরোহিত; যে পয়লাবার শান্তি প্রস্তাব নিয়া হস্তিনাপুর যায়। কিন্তু দ্রপদ যেইভাবে তারে কাজ বুঝাইয়া দিছেন আর রাজসভায় তারে যেইভাবে ভীষ্ম এমনকি কর্ণ পর্যন্ত ঝাড়ি দেয়; তাতে তার সামাজিক অবস্থান যে কোনোভাবেই উপরের দিকে না তা কিন্তু এক্কেবারে পরিষ্কার হইয়া যায়। উল্টাদিকে রামায়ণে বিশ্বামিত্র-বশিষ্ঠগো দাপট ছাড়াও গৌতমপুত্র তরুণ শতানন্দ যেই রকম ব্যক্তিত্ব নিয়া রাজার লগে কথা কয়; তাতে নিশ্চিত ধইরা নিতে হয় যে রামায়ণ সমাজে পুরোত বামুনের স্থান যেকোনো মন্ত্রী থাইকাও উপরে…
অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসু আমাগো মনে করাইয়া দেন যে মহাভারতে একবারের লাইগাও কিন্তু কৃষ্ণের মুখে বামুন বন্দনা কিংবা শূদ্র নিন্দার কথা শোনা যায় না। মানে মহাভারত যুগ পর্যন্ত এই দুইটার কোনোটাই আছিল না। তার আরেকটা প্রমাণ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে কুন্তীর আয়োজনে নয় পুত্রবধূর এক্কেবারে মাঝখানের আসনে শূদ্রেতর অনার্য নারী হিড়িম্বারে বসানোর আয়োজন থাইকাও আমরা অনুমান করতে পারি…
কৃষ্ণভক্ত বামুন বঙ্কিমচন্দ্র যেইখানে খালি শূদ্রঘরে জন্মাইবার কারণে শূদ্রগো ছ্যা ছ্যা কইয়া তার ভগবদগীতায় ঘিন্না করেন; সেইখানে বঙ্কিমের ভগবান কৃষ্ণ কোনো শূদ্রনিন্দাই করেন নাই; কারণ চতুবর্ণ জিনিসটা মহাভারতের আরো প্রায় পাঁচশো বছর পরে বঙ্কিমচন্দ্রের মতো ধুরন্দর বামুনগো হাতে আবিষ্কৃত জিনিস। মহাভারতে যা আছে তা কিন্তু ব্যক্তির বন্দনা কিংবা নিন্দা; সেইটা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের লাইগাই। তার জাতের লাইগা না। সেইখানে পরের ঘরের বৌ টানাটানি করার লাইগা ভরদ্বাজের মতো ঋষি বামুনের পোলারে আমরা পাব্লিকের হাতে পিটানি খাইয়া মরতে কিংবা অস্ত্র চুরির লাইগা সন্ন্যাসী বামুনরে ভীমের হাতে কিল খাইয়া মরতে যেমন দেখি; তেমনি বিনাবাক্যে সকলরেই দেখি মাইমল কন্যা সত্যবতীর পোলা দ্বৈপায়নের কথা মাথা পাইতা নিতে…
বামুনরা ধীরে ধীরেই তাগো পরখাউকি পদ সুরক্ষিত করছে রাজতন্ত্রের ভিতর। বহুত বহুত সময় লাগছে এতে। বেদ প্রচার- যজ্ঞ- উপনিষদ- পুরাণ- গীতা এমনকি পূজা পদ্ধতি প্রচলন হওয়া পর্যন্ত চলছে বামুনগো অবস্থান নিশ্চিতকরণের প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ারে মাথায় রাইখা মহাভারতের দিকে তাকাইলে এইটা অন্তত নিশ্চিত মনে হয় যে মহাভারতকালে অগোছালোভাবে ঋগবেদ এবং হয়ত অন্য বেদগুলার কিছু কিছু বিধান বা শ্লোক প্রচলিত থাকলেও বৈদিক সিস্টেমের লাঠিটারে বামুনরা তখনো ঠিকমতো জুইত কইরা ধরতে পারে নাই। যেইটা রামায়ণ সময়ে আইসা মোটামুটি পোক্ত কইরা ধরছে তারা…
মহাভারত সময়ে বেদের শ্লোকগুলা অগোছালো অবস্থায় থাকার একটা ইংগিত মহাভারতের রচয়িতার জীবনীতেই আছে। সেইখানেই কওয়া হইছে যে অগোছালো বেদগুলারে দ্বৈপায়নই পয়লা গুছায়া সংকলন করেন; যদিও সুকুমারী ভট্টাচার্যের ভাষায় কইতে হয় যে ‘শাস্ত্রে ব্যাসের মৃত্যুর কথা লেখে না’ তবুও সত্য হইল যে দ্বৈপায়নের জীবনী রচনা করা হইছে তিনি মইরা যাবার অন্তত ছয়-সাতশো বছর পরে…
রামায়ণরে মহাভারতের পরের আখ্যান কইতে গেলে সব থিকা বড়ো বাধাটা আসে অবতারবাদী বৈষ্ণবগো কাছ থিকা। তাগো হিসাব মতে রাম বিষ্ণুর সপ্তম আর কৃষ্ণ হইলেন অষ্টম অবতার…
অবতারবাদী ধারণামতে বিষ্ণুর দশজন অবতারের মইদ্যে নয়জন আইসা গেছেন আর ভবিষ্যতে কল্কি অবতার নামে আরো একজন আসবেন। তবে আইসা পড়া নয় অবতারের তালিকায় কিন্তু ভিন্নতা আছে…
তালিকায় বিষ্ণুর অবতারগো মইদ্যে পয়লা তিন অবতার মাছ-কচ্ছপ-শূওর। চতুর্থ অবতার আধা মানুষ আধা সিংহ। পঞ্চম অবতার এক অপূর্ণ মানুষ বা বাইট্টা মানুষ। বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার হইলেন ভার্গব বংশের পরশুরাম; পয়লাবারের মতো এক পূর্ণ মানুষ। এই তালিকার সাত নম্বরে রাম আট নম্বরে কৃষ্ণ। যদিও ছয় নম্বর পরশুরামরে আমরা সাত আর আট নম্বরের সময়ও কুড়াল হাতে নিয়া ঘুরাঘুরি করতে দেখি…
অবতার তালিকার নয় নম্বরে দক্ষিণ ভারতীয় তালিকায় আছে কৃষ্ণের ভাই বলরামের নাম। অন্যসব তালিকায় বলরামের জায়গায় গৌতম বুদ্ধ। আবার গৌড়ীয় আর নিম্বার্ক এর মতো মধ্যযুগীয় বৈষ্ণবগো তালিকায় অবতার হিসাবে কৃষ্ণর নাম নাই। এইসব মতে কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান; কৃষ্ণ শুধু অন্যান্য অবতারগো উৎসই না; স্বয়ং বিষ্ণুরও উৎস তিনি…
কৃষ্ণ বিষ্ণুর উৎস কথাটারে সোজা বাংলায় অনুবাদ করলে কিন্তু খাড়ায় যে বিষ্ণু বা নারায়ণের সৃষ্টিকর্তা হইলেন কৃষ্ণ। বেদে বিষ্ণু বা নারায়ণের কোনো অস্তিত্বই নাই। যদিও বেদের কয়েকজন বসু কিংবা সূর্যর লগে বিষ্ণু বা নারায়ণের সম্পর্ক দেখানোর একটা চেষ্টা করা হয়; কিন্তু বেদে বসুরা যেমন নগণ্য দেবতা তেমনি সূর্যও তাই। মূলত ব্রহ্মা এবং শিবের মতো নারায়ণ বা বিষ্ণুও অবৈদিক লৌকিক দেবতা….
ঠিক এই জায়গাটায় সুকুমারী ভট্টাচার্য আর নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর রচনা সামারি করলে কিন্তু সরাসরি বইলা দেয়া যায় যে- আইজকার ভগবান নারায়ণ বা বিষ্ণুর সৃষ্টি হইছে স্বয়ং বাসুদেবপুত্র কৃষ্ণ এবং তার ভার্গব বংশজাত আত্মীয় স্বজনের হাতে। কৃষ্ণ দ্বারা নারায়ণী বা ভাগবতী বা পাঞ্চজন্য ধর্মের প্রচার আর তার সংকলন হিসাবে ভগবৎগীতা রচনা; সব কিছুই ঘটছে তথাকথিত কুরুযুদ্ধের পরে…
কৃষ্ণের বুদ্ধিতে কুরুযুদ্ধ জয় কইরা সম্রাট হইবার পর যুধিষ্ঠির কিন্তু কৃষ্ণরে ফালায়া দেয়। বলতে গেলে হস্তিনাপুর থাইকা খেদাইয়াই দেয়। রাজসূয় যজ্ঞে যেই কৃষ্ণরে যুধিষ্ঠির দেবতার অর্ঘ্য দেয়; সম্রাট হইবার পর তার অশ্বমেধ যজ্ঞে সেই কৃষ্ণরে নিমন্ত্রণখান পর্যন্ত করে না যুধিষ্ঠির। এই পর্বে যুধিষ্ঠির পুরাই চইলা যায় কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের কব্জায়। এই নিয়া ভাইয়েগো মাঝে গ্যাঞ্জামও হয়। যুধিষ্ঠিরের লগে গ্যাঞ্জামে অর্জুন ভিন্নভাতে বাস করতে থাকে ইন্দ্রপ্রস্থ গিয়া। আর বাকি তিন ভাই থাকে সম্রাটের লগে হস্তিনাপুর। এই পর্বে পাণ্ডবগো মাঝে কৃষ্ণের যোগাযোগ থাকে একমাত্র তার বন্ধু আর বইনের জামাই অর্জুনের লগে। যুধিষ্ঠিরের সাথে এক্কেবারেই না। এর পিছনে কিন্তু মূল কাঠি নাড়েন বেদজ্ঞ কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন….
কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন কৃষ্ণরে বেদবিরোধী মানুষ বইলাই প্রচার করতেন। এই পর্বটারে অনেকেই কৃষ্ণের পতন কইলেও সেইটাই কিন্তু কৃষ্ণ-জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যায়। কারণ হস্তিানপুর থাইকা বহিস্কৃত হইবার পরেই অন্য এক পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করেন কৃষ্ণ। যুদ্ধমুদ্ধ বাদ্দিয়া কৃষ্ণ শুরু করেন ধর্মের প্রচার। ভক্তিবাদী ধর্ম। নারায়ণী অথবা ভাগবতী অথবা পঞ্চরাত্র। বহুত সম্পাদনা আর সংযোজন বিয়োজনের পর সেইটারই আজকের পুস্তক ভার্সন হইল গীতা আর প্রায়োগিক ভার্সন হইল বৈষ্ণব ধর্ম…
গীতারে বর্তমানে বেদ উত্তীর্ণ দর্শন হিসাবে সাফাই দিয়া বেদের লগে লাইনআপ করা হইলেও গীতা মূলত বেদবিরুদ্ধ দর্শন। যার লাইগা ঘাটে ঘাটে কৃষ্ণের এইটা বাধাপ্রাপ্ত হয় দ্বৈপায়নের কাছে।
কৃষ্ণের ধর্মপ্রচার থামাইতে না পাইরা পুরা যাদব বংশটারেই নির্বংশ কইরা দেন বেদব্যাস কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। মহাভারতে নারদ টারদের যেইসব অভিশাপে যাদবকূল ধ্বংস হইবার কথা পাওয়া যায় সেইগুলা ভূয়া। মূলত দ্বৈপায়ন আর তার বেদব্যাস ঘরাণাই যাদব বংশরে নাশ কইরা দেয়…
বড়ো বেঘোরে ধ্বংস হয় কৃষ্ণের বংশ। বড়োই করুণ মৃত্যু ঘটে কৃষ্ণের। বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়- মানবেতিহাসের হীনতম মৃত্যু। কিন্তু বংশনাশ হইয়া গেলেও কোনোভাবে টিকা থাকে কয়েকটা জিনিস; ভাগবতী বা নারায়ণী ধর্ম; বেদ বিরুদ্ধ ভগবতগীতা; দেবতা হিসাবে নারায়ণের প্রতিষ্ঠা; আর নারায়ণ বা বিষ্ণুর প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে যাদব কৃষ্ণ স্বয়ং…
ভাগবতী ভক্তিবাদী দর্শন এক্কেবারে কিন্তু একলা কৃষ্ণের আবিষ্কার না; এর কিছু কিছু উপাদান আগেও আছিল। বিশেষ কইরা এর উপর উপনিষদের ব্রহ্মতত্ত্বের প্রভাব বহুত। তবে ব্রহ্মতত্ত্ব আর বৈষ্ণব ধর্মে বর্তমানে ফারাকের পরিমাণই বরং বেশি। কৃষ্ণ বৈদিক যজ্ঞ-মজ্ঞর স্থলে নিয়া আসেন ভক্তিরে; ধীরে ধীরে তৈরি হইতে থাকে গীতার দর্শন। অবতার জিনিসটা মূলত ভগবানরে নিজের ঘরে নিয়া আইসা ঘনিষ্ঠ হিসাবে অনুভব করানোর কৌশল। এই ভগবান বৈদিক লুজ কারেক্টার দেবতা না; যারে চাইলেই মাইর দেয়া যায়। আবার উপনিষদের নিরাকার ব্রহ্মাও না; যারে দেখাও যায় না ছোঁয়াও যায় না; অনুভব তো দূরের কথা…
উপনিষদের নিরাকার ব্রহ্ম কিন্তু কোনো বামুনের উদ্ভাবন না; একজন রাজার উদ্ভাবন। ক্ষত্রিয় প্রবাহণ তার নিরাকার ব্রহ্মারে পরিচয় করানোর লাইগা শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করেন ঋষি উদ্দালক আরুণীরে। প্রবাহণের ব্রহ্মতত্ত্বরে প্রচার করার লাইগাই ঋষি উদ্দালক তার পোলা শ্বেতকেতুরে নিয়া শুরু করেন উপনিষদ রচনার সূচনা। উপনিষদ রচনা কিন্তু চলতে থাকে মোটামুটি খিপূ তৃতীয় শতক পর্যন্ত। মানে বৌদ্ধ ধর্ম আর বৈষ্ণব ধর্মের সমান্তরালে বহু বছর। কিন্তু এর মইদ্যেই বৈষ্ণব ধর্ম ছাপাইয়া উঠে বৈদিক-উপনিষেদিক কিংবা শৈবধর্মসহ বর্তমান হিন্দুবাদী অন্য সকল ধর্মের উপরে। আত্মা কর্মফল ভক্তি এই উপাদানগুলারে মিলায়া মিশায়া গেরস্থ কিংবা সন্ন্যাসী সকল ভক্তের কাছে ফলাফলহীন ভক্তি প্রত্যাশা কইরা কৃষ্ণ নিজেরে স্থাপন কইরা দেন স্বয়ং ভগবানের স্থানে; নারায়ণ; বিষ্ণু…
কৃষ্ণর ধর্মপ্রতিষ্ঠায় কৃষ্ণউত্তরকালে মূল কামটা করেন ভার্গববংশজাত তার আত্মীয়েরা। যে দ্বৈপায়ন গীতার বিরোধীতা করছেন; ভার্গবরা সেই গীতারেই নিয়া ঢুকাইয়া দেয় দ্বৈপায়নের মহাভারতের ভিতর। রচনা করে কুরুযুদ্ধের আখ্যান। আগাগোড়া বদলাইয়া দেয় মহাভারতের অধ্যায় কাহিনি এবং পুরা মহাভারতটারেই পরিণত করে কৃষ্ণ কাহিনিতে…
বেদ ছাইড়া কৃষ্ণরে স্বয়ং ভগবানের আসন দিয়া বৈষ্ণব ধর্ম ছড়াইয়া পড়ে বেদোত্তর কালে। অবতারবাদীরা অবশ্য কৃষ্ণরে ভগবান না বইলা সিরিয়ালি অবতারগো মাঝে সব শেষের সিরিয়ালে রাইখা বৈষ্ণব ধর্মরে পোক্ত করেন। কৃষ্ণরে আইসা পড়া নয় অবতারের সিরিয়ালের শেষে রাখার উদ্দেশ্য হইল এর পরে যাতে আর কেউ কৃষ্ণকথার উপর খবরদারি করতে না পারে। অনেকটা নবী মোহাম্মদের পুরানা সকল নবীরে একটা কইরা সালাম দিয়া নিজেরে শেষ নবী ঘোষণা কইরা নতুন নবী আসার দরজায় পেরেক মাইরা দিবার মতো। তবে মোহাম্মদ যেমন ভবিষ্যতে একজন ইমাম মেহদি আসার একটা চিপা রাস্তা খোলা রাখছেন; তেমনি অবতারবাদীরাও একটা চিপা রাস্তা খুইলা রাখছে ভবিষ্যতে একজন কল্কি অবতার আসার লাইগা। কিন্তু এইটাও নিশ্চিত যে এখন কল্কি অবতার কইয়া কারো আর খাড়াইবার প্রায় কোনো চান্স নাই এই জটিল মনস্তাত্ত্বিক যুগে…
প্রশ্ন হইল অবতার হিসাবে কৃষ্ণের পরে রামের দরকার হইল ক্যান? অবতারের তালিকার দিকে তাকাইলে একটা জিনিস পরিষ্কার হইয়া যায় যে সেই তালিকায় কৃষ্ণের আগে যাগো নাম পাওয়া যায় তাগো মাঝে কৃষ্ণ ছাড়া কেউই কীর্তিমান না। সিরিয়ালি পয়লা চাইর জন এমনকি মানুষও না; বরং তারা মাছ কচ্ছপ শুওর আর সিংহ। অবতারের তালিকায় পয়লা যে মানুষের দেখা মিলে সে আবার বামন কিংবা অপূর্ণ মানুষ। তালিকার ছয় নম্বরে একজন পূর্ণ মানুষের নাম পাইলেও সেই পরশুরামের আদৌ কী বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে তা খুইজা বাইর করা মুশকিল। পরশুরামের যা গল্প পাওয়া যায় তার মইদ্যে আছে বাপের মরার প্রতিশোধ নিতে একুশখান বেহুদা হত্যাযজ্ঞের কাহিনি। আর আছে অস্ত্র শিক্ষার ইস্কুল চালানো। আর তার লগে আছে নিজের মায়েরে খুন করার মতো মাতৃঘাতী অপবাদ। বৌ নাই; পোলাপান নাই; সমাজ নাই; মানবজাতির উপকারের কোনো রেকর্ডও নাই…
সুকুমারী ভট্টাচার্যের ভাষায় অবতারগো মাঝে কৃষ্ণই একমাত্র ত্রাতা। তার সকল কাজই অন্যের লাইগা। শিশুপালের বাগদত্তা রুক্ষ্মিণীরে জোর কইরা বিবাহ করা ছাড়া নিজের শক্তি দিয়া নিজের লাইগা আর কিচ্ছু করেন নাই তিনি। বাকি সব কাজ অন্যের লাইগা। রাজা বানাইছেন কিন্তু রাজা হন নাই…
কিন্তু কৃষ্ণ এক নিম্নবর্গের চাষী পরিবারের কালা রংয়ের মানুষ। কোনোভাবেই কোনো রাজবংশের মানুষ না। একজন যোদ্ধা আর বড়োজোর দার্শনিক মাত্র। সবচে বড়ো বিষয় হইল কৃষ্ণের যুদ্ধটা পুরাপুরি বৈদিক সমাজেরই বিপক্ষে; বামুনগো সম্মান টম্মান দেখানোর তেমন কোনো উদাহরণ নাই তার। তার উপরে বড়ো বেঘোরে নির্বংশ হইতে হইছে মানুষটারে। তার উপরে তার প্রকাশিত যোদ্ধা আর কূটনীতিবিদের জীবন; যেইখানে ভালো কাম করার থাইকা ভালো কইরা কাম করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ আছিল; যার লাইগা সততা ফততারে কূটনৈতিকের মতো হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করলেও কৃষ্ণের পক্ষে সেইগুলারে মাইনা চলা সম্ভব আছিল না…
কৃষ্ণ সততার কথা কইতেন; সততারে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতেন; কিন্তু কোনোভাবেই বলা যাবে না যে তিনি আগাগোড়া আছিলেন একজন সৎ মানুষ। এর সাথে আছে তার বেহদ্দ মাতাল বংশের বদনাম; পরের বাগদত্তা টাইনা আনার দুর্নাম; নিজের মামারে খুন করার দুর্নাম; আছে ঘাটে ঘাটে বিবাহের ইতিহাস; পরিবারে নিজের পোলার লগে সৎমায়ের পরকীয়ার কেলেংকারি…
এইসব ঘটনার লগে গোয়ালা আয়ন ঘোষের ভাইগ্নার মামীরে লইয়া টানাটানি আর কদম ডালের বানরামিও যখন এই কৃষ্ণের ঘাড়েই মূর্খ বৈষ্ণব কবিরা চাপায়া দিলো তখন বৈষ্ণব ভার্গবগো দরকার পড়ল নারায়ণের বিতর্কহীন একজন রাজবংশীয় অবতার…
বিষয় হইল ততদিনে ললিত বিস্তারের কল্যাণে গৌতম বুদ্ধের ক্লিন ইমেজ কিন্তু বিশাল ফ্যাক্টর হইয়া উঠছে। বৌদ্ধ বিপ্লবে হিন্দুধর্মের অবস্থা পুরাই নাজুক। কোথাও কোথাও হিন্দু পণ্ডিতেরা ঘর সামলাইতে গিয়া স্বয়ং বুদ্ধরেই অবতার হিসাবে গ্রহণ কইরা ফালাইছেন। যদিও তখন পর্যন্ত ‘হিন্দু ধর্ম’ কথাটা চালু হয় নাই…
সমস্যা হইল বুদ্ধরে অবতার স্বীকার কইরা হিন্দুধর্ম প্রচার আর প্রচলিত হিন্দু ধর্মের বিপক্ষে বৌদ্ধ ধর্মের অবস্থান দুইটা সম্পূর্ণ দুই মেরুর জিনিস। বৌদ্ধরে হিন্দু অবতার কইলেও বৌদ্ধ ধর্মরে হিন্দু ধর্ম কওয়া সম্ভব না। বরং বৌদ্ধ ধর্ম হিন্দু ধর্মের বিপরীতেই অবস্থান করে। বিশেষত চতুবর্ণ কিংবা জাতপাত কিংবা মাইনসের ঘাড়ে বামুনদের ভূত হইয়া চইড়া বসা; যেইগুলা তখন মাইনসের জীবনরে নরক বানায়া রাখছে। তো এই অবস্থায় বুদ্ধরে পকেটে ঢুকানোর পরেও একজন সম্ভান্ত্র খাঁটি হিন্দু বা বৈষ্ণব অবতার খুব বেশি জরুরি হইয়া পড়ল; যারে গৌতম বুদ্ধের মতো যেমন সম্ভ্রান্ত বংশের পোলা হইতে হবে; তেমনি তার থাকতে হবে বুদ্ধের কাছাকাছি রাজ্য ত্যাগের ইতিহাস; থাকতে হবে সহজ সরল জীবন যাপন; থাকতে হবে নির্লোভ জীবনী। তবে তারে শেষকালে রাজাও হইতে হবে একটা উপযুক্ত হিন্দুরাষ্ট্রের উদাহরণ প্রতিষ্ঠার লাইগা…
অবতারবাদীরা সম্ভ্রান্ত সেই সম্ভাব্য অবতারের সন্ধান পাইয়া যান বাল্মিকীর পুলস্ত্যবধ কাব্যে। রাজা দশরথের পুত্র রাম। বাপের কথা রাখতে গিয়া রাজ্য ত্যাগ কইরা বনে বনে ত্যাগি চেহারা নিয়া ঘোরে। পাশাপাশি পুলস্ত্য বা রাবণরে হত্যা কইরা পুলস্ত্যবধ কাব্যের বিজেতা নায়ক। চরিত্রখানও বহুত নিষ্কলুষ। বাপের সাড়ে তিনশোটা বৌ থাকার পরেও তার মাত্র এক বৌ। পরবর্তীকালে একজন রাজা। বামুনগো তাবেদার; আদিবাসী মাইরা বামুনের যজ্ঞ করার ব্যবস্থা কইরা দেয়। বামুনগো গ্রামের শত্রু নিধন কইরা দেয়। শূদ্র বেদ পইড়া যাতে বামুনগো ফাঁকি ধরতে না পারে তার লাইগা বিনা প্রশ্নে শূদ্রের মাথা নামায়া ফেলে কোপ দিয়া…
বাল্মিকীর পুলস্ত্যবধ কাব্যের বিজেতারে ধইরা বামুনগো লাইগা দরকারি এই সকল গুণই চাপানো হয় রামের উপর; অথবা কিছু কিছু আগে থাইকাই থাকে। পয়লা ধাক্কাতেই বাল্মিকীর পুস্তকখানের নাম পুলস্ত্যবধ কাব্য থাইকা বদলাইয়া করা হয় রামায়ণ। মানে পরাজিতের নামে লেখা কাব্যখান এইবার লেখা হইতে থাকে বিজেতা নায়কের নামে। আর নায়কের উপর ক্রমাগত চাপানো হইতে থাকে বৈষ্ণবগো লাইগা দরকারি সকল উপাদান; এমন কি বৌদ্ধ বিরোধিতাও…
অবতার তালিকায় রাম আর কৃষ্ণের সিরিয়ালের বিষয়ে পৌরাণিক কালচক্রের আরেকটা যুক্তি হাজির করা হয়। বলা হয় রাম ত্রেতা আর কৃষ্ণ দ্বাপর যুগের অবতার। এই যুগ হিসাবটা বড়োই গোলমেলে; এইটা রৈখিক ক্যালেন্ডার না; কালের চক্র। এইসব দ্বাপর ত্রেতা কলি দিয়া কোনো সময়কাল বোঝানো হয় না। কবে থাইকা শুরু আর কবে কোন কালের শেষ তার হিসাব পুরাই ঝাপসা। এই যেমন কোনো এক অতীত কাল থাইকা এখনো চলতে আছে কলিকাল; কিন্তু তার কোনো হিসাব নাই। এইটা নিয়া বেশি ব্যাখ্যায় না যাইয়া খালি কই যে কৃষ্ণভক্ত বঙ্কিমচন্দ্রও এই কালচক্রের হিসাব উড়াইয়া দিছেন; কারো আগ্রহ থাকলে তিনার কৃষ্ণচরিত্র পুস্তকখান দেইখা নিতে পারেন…
রাম আর কৃষ্ণরে যে কালেই অবতার তালিকায় ঢোকানো হউক না ক্যান; মূল বিষয়টা হইল রাম আর কৃষ্ণের সিরিয়াল ঠিক করা হইছে তাগো সময়ের কমপক্ষে হাজার বছর পরে। অবতারের তালিকায় যেই আগে আর যেই পরে থাকুক না ক্যান; ঐতিহাসিক হিসাবে দেখা যায় যে অবতারবাদ জিনিসটাই আবিষ্কার হইছে খ্রিষ্টিয় তৃতীয়-চতুর্থ শতকের দিকে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়। এই অবতারবাদ কনসেপ্টটা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের জাতক কাহিনির একটা এডাপটেশন। বৌদ্ধগোরে গাইল্লাইতে গাইল্লাইতে পৌরাণিকেরা কিন্তু ক্রমাগতভাবে নিজেগো ধর্মরে বৌদ্ধ ধর্মের উপাদানের লগে এডজাস্ট কইরা গেছে। বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়- মহাভারত বা রামায়ণে নাস্তিক বলতে সর্বদাই চার্বাকপন্থী বা বৌদ্ধ বোঝানো হয়েছে। মহাভারতে চার্বাক আছে। কন্ব মুনী কিন্তু চার্বাক পন্থী। আর রামায়ণে আছে বৌদ্ধ; রাজা দশরথের উপদেষ্টা জাবালি বৌদ্ধপন্থী মানুষ…
রামায়ণের সমাজ পুস্তকের লেখক কেদারনাথ মজুমদার পরিষ্কার কইরা কন যে; অবতার তালিকায় রামের অন্তর্ভুক্তি হইছে অবতার হিসাবে গৌতম বুদ্ধের অন্তর্ভুক্তির পরে। গুপ্ত যুগে অবতারের যা ইতিহাস পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় যে সেইখানে অবতার হিসাবে শুধুই বরাহ বা শূকর আর কৃষ্ণের পূজার নিদর্শন আছে; অন্য কেউ না…
উপনিষদের মতো ব্রহ্মবাদী বা গীতার মতো ভক্তিবাদী দর্শনের মিশ্রণে যে বৈষ্ণব ধর্ম বা পরবর্তীকালে হিন্দুধর্ম তৈয়ারি হইছে; সেইটাতে চার্বাকপন্থা কিন্তু কট্টর নাস্তিক্যবাদ হিসাবে বাদই পইড়া গেছে। ভৃগু মুনীর শালা কপিলের বেদবিরোধী দর্শন ত্যাজ্য হইছে। হীনযান যুগের নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মও পুরা সাংঘর্ষিক আছিল উপনিষদ আর গীতার উত্তরাধিকারীগো কাছে। কিন্তু কালে কালে বৌদ্ধ ধর্মও সইরা আসে হিন্দুধর্মের কাছাকাছি। বুদ্ধের নাস্তিক্যবাদরে চাপাইয়া থুইয়া স্বয়ং বুদ্ধরে বানায়া ফালানো হয় ভগবান…
এই পুরা প্রক্রিয়াটা; মানে নারায়ণরে ভগবান হিসাবে প্রতিষ্ঠা- কৃষ্ণর প্রতিষ্ঠা- গীতা- অবতারবাদ- চতুবর্ণ- বর্ণাশ্রম- মনু সংহিতা এবং মহাভারত -রামায়ণ সম্পাদনা দিয়া আধুনিক হিন্দু ধর্মের সূচনাটা ঘটে মূলত ভার্গব বংশ এবং তাগো আত্মীয় স্বজনের হাতে। মহাভারতকাল পর্যন্ত জাতে ব্রাহ্মণ নামে কিছুর অস্তিত্ব আছিল না। জন্মসূত্রে কেউ বামুন হইত না। কামে হইত। জন্মসূত্রে বামুন হইবার সিস্টেমটাও চালু করে এই ভার্গবেরা; যারা আবার নিজেরাই বামুন আছিল না সকলে…
আমরা যে মহাভারত এখন পড়ি; সেইটা এমন এক অজ্ঞাত ব্যক্তির মুখ থাইকা শুনি যিনি সৌতির মুখে শুইনা শুইনা আমাদের বর্ণনা করতে আছেন ঘটনাখান- সৌতি আইলেন; পান তামুক খাইলেন তারপর কইলেন যে জন্মেজয়ের যজ্ঞে এই কাহিনি তিনি শুইনা আসছেন তারপর তিনি কইতে শুরু করলেন সেই কাহিনি…
এই সৌতি একজন ভার্গব বংশজাত মানুষ। সৌতিরে বলা হয় সূত; যাগো পেশা আছিল পুরাণ কথন অথবা রথ নির্মাণ; ভার্গবেরা প্রায় সকলেই কিন্তু আছিলেন সূত। ভার্গব বংশের প্রতিষ্ঠাতা ভৃগু মুনি স্বয়ং আছিলেন একইসাথে ঋষি-ধনুর্ধর-আর রথের মিস্ত্রি; মানে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় আর শূদ্র তিনটাই। মজার জিনিস হইল মহাভারত পড়লে মনে হয় ভৃগুমুনি বোধহয় ভারতে আসা আর্যগো এক্কেবারে পয়লা প্রজন্মের ঋষি। কিন্তু ঋগবেদ রচয়িতাগো মাঝে ভৃগু হইলেন এক্কেবারে শেষের দিকের ঋষি। আদি বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রগো থাইকা বহুত প্রজন্ম পরের মানুষ…
বৈদিক আর ভারতীয় পুরাণ এবং সাহিত্য বিষয়ে সুকুমারী ভট্টাচার্যের অতিমানবিক বিশাল গবেষণার মইদ্যে একটা ছোট্ট প্রবন্ধ হইল ‘ভার্গব প্রক্ষেপণের প্রেক্ষাপট’। যাগো বেশি আগ্রহ আছে তারা পইড়া নিতে পারেন; ভৃগুর বংশধররা কেমনে মহাভারতরে কাটাছিড়া করছে। এমনকি কেউ কেউ বলেন আদতে দশ বিশজন মানুষের মাঝে লাঠালাঠি কিলাকিলির যে কুরু-পাঞ্চাল যুদ্ধ হইছিল সেইটাতে জয়ী হইছিল কুরুরাই। পরে সেইটারেই ভার্গবরা কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধর আকার দিয়া পাণ্ডবগো জিতায়া দিয়া আজকের কুরুযুদ্ধের আখ্যান তৈয়ারি করছে কৃষ্ণরে স্থাপন করার লাইগা। সুকুমারী ভট্টাচার্যের হিসাবে এই ভার্গব বামুনরাই হইলেন আজকের হিন্দু ধর্মের উদ্ভাবক; শুধু মহাভারত দিয়া না; রামায়ণ এবং মনু সংহিতা দিয়াও। কারণ রামায়ণের বাল্মিকী যেমন ভার্গব; তেমনি মনু সংহিতার রচয়িতাও ভার্গব ঘরানার মানুষ…
সুকুমারী ভট্টাচার্য যে বংশটারে দুর্বল হাতে; নিম্নমানের সাহিত্য দক্ষতা আর উচ্চমানের মূর্খতা নিয়া শত শত বছর ধইরা মহাভারত-রামায়ণ সম্পদনা পরিবর্তন আর পরিবর্ধনের লাইগা দায়ি গোষ্ঠী হিসাবে চিহ্নিত করেন। সেই ভার্গব বংশের কিছু কাহিনি আলাপ না করলে ভারতীয় পৌরাণিক আখ্যান তৈরির পিছনের একটা বড়ো ফ্যাক্টর যেমন বাদ থাইকা যাবে; তেমনি বাদ পইড়া যাবে আধুনিক হিন্দুধর্মের উৎপত্তির বহুত ইতিহাস…
খিপূ ২০০০ সালের দিকের ঘটনা। তখনো ইরানিরা বা আর্যরা ভারতে ঢোকে নাই। তাগো একটা দল তখন বাস করত বর্তমান তাজাকিস্তানের পশুরজন আর নিম্ন মাদ্রজন অঞ্চলে। এই গোষ্ঠীটারে আরেকটা যাযাবর আর্যগোষ্ঠী ইন্দ্র নামে এক সেনাপতির নেতৃত্বে পিটায়া ভিটামাটি থাইকা খেদাইয়া ভূমি-সম্পত্তি আর নারীগো দখল কইরা নেয়। ইন্দ্র কিন্তু তখনো সেনাপতির পদ কিংবা নাম। মাইর খাইয়া পশুরজন থাইকা পলানো মানুষগুলা পরবর্তীকালে পরিচিত হয় পারস্য পারসিক বা পার্সিয়ান নামে…
খুব সম্ভবত সেনাপতি ইন্দ্রের নেতৃত্বে পশুরজনবাসীগো মাইর দেওয়া আর্যগো দলের বংশধররাই পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ভারতের মূল দখলটা নেয় আর ধীরে ধীরে এককালের সেনাপতি ইন্দ্রর নামটা কালে কালে পরিণত হয় দেবতাগো রাজার নাম হিসাবে। অন্যদিকে মাইর খাওয়া পশুরজনের লোকজন বা পার্সিয়ানরা দুইদিকে ছড়ায়; একদল আফগানের ব্যকট্রা বা বহ্লীক থাইকা ইরাণের মূল ভূখণ্ড। আরেকদল ব্যকট্রা থাইকা ভারতের মূল ভূখণ্ড…
ভারতে কিংবা ইরানে; কোথাও এই মানুষগুলা কিন্তু ইন্দ্র বাহিনির হাতে নিজেগো ভিটা হারানোর ইতিহাস ভুলতে পারে নাই। ভূমি থাইকা উচ্ছেদ হওয়া এই পশুরজন বা পার্সিয়ানগো স্পিতামা গোত্রের মানুষ হইলেন মুনি ভৃগু; যিনি ভারতভূমিতে ভার্গব বংশের প্রতিষ্ঠাতা। এক হিসাবে বেদের অবহেলিত দেবতা বরুণের পুত্র হইলেন এই ভৃগু মুনি; অন্য দিকে এই বরুণই হইলেন জেন্দাবেস্তার প্রধান দেবতা আহুর মাজদা…
ভৃগুমুনীর বড়ো মাইয়া লক্ষ্মী; আখ্যানমতে নারায়ণের স্ত্রী; আইজ পর্যন্ত তিনি দেবী হিসাবে পূজিত হন। তার বড়োপোলা পুলমাগর্ভজাত চ্যাবন মুনি; যিনি ভেষজ-বিদ্যার বিশেষজ্ঞ আছিলেন। আখ্যান বিশ্লেষণ করলে এই চ্যাবনরেই ধইরা নিতে হয় ফুল-ফল-ফসল গ্যাঁজাইয়া চোয়ানি মদের আবিষ্কারক বা ঋষি সুরা হিসাবে। যিনি মদ বানায়া দুই শিষ্য অশ্বিনীকুমারগো দিয়া ঘোড়ায় দূর দুরান্ত পর্যন্ত মদ সাপ্লাই দিতেন। আরেক হিসাব মতে এই চ্যাবনই আদি বাল্মিকী; রামায়ণের আদি রচনাকার…
অশ্বঘোষের মতে রামায়ণের বাল্মিকী এই চ্যাবনমুনিরই পুত্র। ভৃগুমুনীর দ্বিতীয় পোলা ঋচীক; নিজে তেমন বিখ্যাত ঋষি না; বিবাহসূত্রে তিনি বিশ্বামিত্রের বড়ো বইন সাবিত্রীর স্বামী। তবে ঋচীকের পোলা আর নাতি কিন্তু আবার বিখ্যাত মানুষ। তার পোলা জমদগ্নি আর নাতি পরশুরাম। পরশুরাম অস্ত্রবিদ্যার একটা স্কুলিং এর যেমন প্রতিষ্ঠাতা তেমনি বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার হিসাবেও গণ্য…
ভৃগুমুনীর ছোটপোলা উশনা গর্ভজাত শুক্রাচার্য; ভারতীয় পুরাণে সব থিকা বড়ো যুদ্ধ বিশারদ আর শল্য-বিদ্যার বিশেষজ্ঞ। শুক্রাচার্যের আরেক উপাধী কিন্তু কবি! অঙ্গিরা বংশ সর্বদাই ইন্দ্রের দলে থাকত বইলা ভৃগুপুত্র শুক্রাচার্য সব সময় থাকতেন অপজিশন; মানে অসুর রাক্ষস আর দানবগো লগে। বেদের কোনো তোয়াক্কা করতেন না তিনি। একলার বুদ্ধি আর কৌশলেই তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলারে টিকাইয়া রাখতেন দেবতাগো আক্রমণের মুখে। তিনি নিজে ব্রাহ্মণ হইয়া; সংহিতামতে নিষিদ্ধ হইবার পরেও নিজের মাইয়া দেবযানীর বিবাহ দেন ক্ষত্রিয় রাজা যযাতির লগে। আর সেই ঘটনার ফল হিসাবেই শুক্রচার্যের মাইয়া দেবযানীর বংশধারায় জন্ম নেন বাসুদেব কৃষ্ণ…
চতুবর্ণের স্রষ্ঠা মনুও জন্ম নেন এই একই ভার্গব বংশের শাখায়। আবার এই শুক্রাচার্যই নিজের জামাই যযাতিরে ধামকি দিয়া বাধ্য করেন রাক্ষসবংশজাত দাসী শর্মিষ্ঠারে রানির মর্যদা দিতে; যার ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয় মহাভারতের শান্তনু পরিবার…
ভৃগু বংশের আত্মীয়গো মাঝে ভৃগুমুনীর শালা কপিল মুনি কঠিন বেদ বিরোধী হিসাবে পরিচিত। ঋচীকের শালা বিশ্বামিত্র বংশ আগাগোড়াই বশিষ্ঠ এবং সেই সূত্রে দ্বৈপায়ন গোত্রের বিরোধী মানুষ…
ভারতের বাইরে এই স্পিতামা গোত্রের আরেকজন মানুষ হইলেন পার্সিয়ান ধর্মের প্রবর্তক জরথ্রুস্ট। যিনি তার জেন্দাবেস্তায় ভালো পন্থাগুলারে কন স্পেন্ত মৈনু মানে স্পিতামা গোত্রের পথ আর খারাপ পথগুলারে বলেন অঙরা মৈনু; মানে ঋষি অঙ্গিরার পথ…
জেন্দাবেস্তা আর ঋগবেদ শুধু সমসাময়িক গ্রন্থই না বহুত ভাষা আর শ্লোকও এক। মূলত দুইটারই আদিসূত্র বা আদিবাস একই অঞ্চলে হইবার কারণেই এইটা ঘটছে। কিন্তু জেন্দাবেস্তা বর্ধিত হইছে ইন্দ্র এবং ইন্দ্রসহচরগো নেতিবাচকভাবে চিহ্নিত কইরা। পার্সিয়ানরা আগুনরে খুব পবিত্র মনে করত আর মরা লাশেরে অপবিত্র; কিন্তু ঋষি অঙ্গিরা লাশ পোড়াইবার বিধান দিবার কারণেই ইন্দ্রের লগে লগে তাগো রাগ গিয়া পড়ে অঙ্গিরার উপর। আর মোটামুটি আগাগোড়াই অঙ্গিরার বংশধররা আছিলেন দেবরাজের রাজকীয় পুরোহিত। আর ভৃগুবংশ অপজিশন। অঙ্গিরা আর ভৃগু এক্কেবারে সমবয়েসি মানুষ…
মাইর খাওায়া একটা গোষ্ঠি যে হাজার বছর ধইরা মাইরের প্রতিশোধ নিয়া বেড়ায় সেইটা এই ভার্গব বংশটার ইতিহাস না পড়লে বোঝা অসম্ভব। বংশটায় এক পাশে যেমন যুদ্ধাস্ত্র আবিষ্কার আর যুদ্ধের ইস্কুল চালাইছেন ভৃগু-শুক্রাচার্য-পরশুরামেরা এবং তাগো আত্মীয় বিশ্বাামিত্র কিংবা কপিলেরা; তেমনি অন্যদিকে বিদ্যালয় খুইলা বুদ্ধির যুদ্ধ চালইছেন জরথ্রুস্ট- চ্যাবন- সৌতি- বাল্মিকী- মনু আর হাজারে হাজার নাম না জানা ভার্গব সন্তান…
ভার্গবগো কোনো অস্ত্রের নিদর্শন আইজ আর নাই। ভার্গব বংশের একটা শাখা; ভিল উপজাতি ছাড়া ভার্গবগো অস্ত্রের কথা আইজ আর স্মরণও করে না কেউ। কিন্তু তাগো বিদ্যার প্রভাবে দুনিয়াতে দুই দুইটা ধর্ম তৈরি হইয়া টিকা আছে আইজ; হিন্দু আর পার্সিয়ান। এই দুইটা ধর্মই সেই ভূমিহারা স্পিতামা গোত্রের ভার্গব মানুষগো অবদান কিংবা আকামের ফল। এরাই লিখছে জেন্দাবেস্তা। লিখছে মনু সংহিতা। লিখছে রামায়ণ আর পুরাই বদলাইয়া দিছে বশিষ্ঠ বংশের হাতে রচিত মহাভারতের ঘটনা এবং কাহিনি। কাকের বাসায় কোকিলের ছানা পয়দা করার আদর্শ উদাহারণ বোধহয় মহাভারতের থাইকা বড়ো কিছু নাই। বশিষ্ঠগোত্রজাত দ্বৈপায়ন পুস্তকখান লিখছিলেন বেদের শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে আর ভার্গবেরা সেইটা এডিট কইরা বানাইয়া থুইছে বেদ বিরোধী ভগবদগীতার আতুড়ঘর…
তবে একটা কথা মাথায় রাখা দরকার। তা হইল ভারতীয় পুরাণে ফেমিলি ট্রি নিশ্চিত কইরা বলা বোধহয় সম্ভব না। ‘ফেমিলি নেট’ হইতে পারে। কারণ এইখানে যে বংশের পরিচয় দেয়া হইছে তাতে একশোটা চ্যালেঞ্জ করা যাইতে পারে। চ্যাবন আদি ভৃগুর পোলা না হইয়া অন্য ভৃগুর পোলাও হইতে পারেন। আবার ঋচীক হইতে পারেন আরেক ভৃগুর পুত।। শুক্রাচার্য চ্যাবন বা ঋচীকের ভাই না হইয়া ভাতিজাও হইতে পারেন। ভৃগুরে কবিও বলা হইত। সেই হিসাবে শুক্রাচার্য কবিপুত্র। আবার ভৃগুরে কবিপিতাও বলা হয়; সেই হিসাবে শুক্রাচার্য ভৃগুর নাতি। আবার শুক্রাচার্য নিজেই কবি। সেই হিসাবে…
আবার পরশুরাম ঋচীকের নাতি না হইয়া অন্য কোনো জমদগ্নির পোলাও হইতে পারেন। একইভাবে কপিল মুনি এক হিসাবে যেমন শুক্রাচার্যের মামা; মানে তার সৎভাই চ্যাবনের মামা; ভৃগুর শালা; আরেক হিসাবে কিন্তু শুক্রাচার্যের এক শিষ্যও চ্যাবন মুনি। এখন কোনজন আসলে কে?
একইভাবে কোন বিশ্বামিত্র কোন ঋচীকের শালা; সেইটা কিন্তু বাইর করা অসম্ভব। কারণ ঋগবেদের আদি রচয়িতাগো মইধ্যে আছেন আদি বিশ্বামিত্র; যিনি ঋচীকের বাপ ভৃগুরও বহুত পূর্ব প্রজন্মের মানুষ; সুতরাং আদি বিশ্বামিত্র ভৃগুপুত্র ঋচীকের শালা হইবার কথা না। আবার আদি বিশ্বামিত্রের সমসাময়কি বশিষ্ঠ কিন্তু দ্বৈপায়নের বাপের ঠাকুরদা না; দ্বৈপায়নের বাবা পরাশর যেমন অন্য বশিষ্ঠের নাতি তেমনি রামায়ণের বশিষ্ঠ আরেকজন…
হইলে হইতে পারে দ্রোণাচার্যের বাপ ভরদ্বাজ বৃহস্পতি-মমতার সন্তানই না। না হইবারই সম্ভাবনা বেশি। হইলে হইতে পারে দ্রোণপিতা মূলত কোনো ভরদ্বাজী টোলে পড়া বামুন মাত্র; বৃহস্পতির লগে যার কোনো সম্পর্কই নাই। অবশ্য বৃহস্পতি বলতে কোন বৃহস্পতি সেইটাও একটা প্রশ্ন। হাজারো বৃহস্পতির মাঝে ঠিক কোনজন যে অঙ্গিরার মাইজা পোলা সেইটা কিন্তু বাহির করা মুশকিল…
মূলত যারা নিজের নামে ঘরানা তৈরি করতে পারে নাই তারা সকলে আগের বিখ্যাত ফ্যামিলি নেম বা ঘরানার নামে পরিচিত আছিল। বহুত লোক আছিল বৃহস্পতি ভৃগু বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র বাল্মিকী দ্বৈপায়ন জমদগ্নি ভরদ্বাজ নামে পরিচিত। বহুত লোক শুক্রাচার্য চ্যাবন পরশুরাম কপিল নামে পরিচিত। আর ব্যাস নামে পরিচিত লোকজন তো দিব্যি এখনো আছে…
তথ্যসমর্থন:
কাহিনিসূত্র: প্রচলিত বাল্মিকী-প্রাদেশিক-আঞ্চলিক এবং উপজাতি রামায়ণ আখ্যান। কালীপ্রসন্ন মহাভারত। রাজশেখর বসুর সংক্ষিপ্ত মহাভারত ও রামায়ণ। প্রচলিত বেদ উপনিষদ এবং পুরাণ সংগ্রহ;
যুক্তিসূত্র: রামায়ণের সমাজ- কেদারনাথ মজুমদার। ভারতবর্ষের ইতিহাস-রোমিলা থাপার। বাল্মিকীর রাম ও রামায়ণ, মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণ -নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী। বাল্মিকী রামায়ণে রাম আদিবাসী রামায়ণে রাম- বিপ্লব মাজি। ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, মহাভারত ও সিন্ধু সভ্যতা, ভারতের বিবাহের ইতিহাস- অতুল সুর। প্রবন্ধ সংগ্রহ- সুকুমারী ভট্টাচার্য। ধর্মের উৎস সন্ধানে- ভবানীপ্রসাদ সাহু। কৃষ্ণ চরিত্র, শ্রীমদভগবদগীতা- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। মহাভারতের কথা- বুদ্ধদেব বসু। মহাভারতের মূল কাহিনি ও বিবিধ প্রসঙ্গ- শিশির কুমার সেন। ধর্ম ও প্রগতি- জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায়। রামায়ণ: খোলা চোখে, কৃষ্ণ কাহিনী মহাভারত- হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়…