কবিতা ও গণিতের মধ্যকার রংধনু সেতু – মাসুদ খান
“দেখেছি কবিতাগুলি বিকশিত হয়ে বিশুদ্ধ গণিত হয়ে গেছে”
–বিনয় মজুমদার
কুহক ও কূটাভাসে জড়ানো এই উক্তি। কারণ আমরা জানি– গণিত হলো সেই বিষয়, যা যুক্তির শৃঙ্খলা গড়ে এবং মেনে চলে। প্রকৃতপক্ষে গণিত হচ্ছে যুক্তি ও শৃঙ্খলার সর্বোচ্চ রূপ। পক্ষান্তরে কবিতা প্রতিনিয়তই ভেঙে দেয় প্রথাগত যুক্তির শৃঙ্খলা।
আবার গণিত নিজেই এক উচ্চতর ভাষাব্যবস্থা– স্বতন্ত্র, স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই যে আমরা জগতের অনেক কিছুই বুঝতে পারি না, মূল কারণ আমাদের ভাষার সীমাবদ্ধতা। প্রচলিত কোনো ভাষাই পারছে না দুর্জ্ঞেয় দুর্বোধ্য বিষয়গুলিকে আমাদের অনুধাবনের উপযোগী করে পরিবেশন করতে। তাই আবিষ্কৃত হয়েছে এই উচ্চতর ভাষা– গণিত। এবং কালে কালে বিকশিত হয়েছে সেই ভাষা। বিশ্বপ্রকৃতির অনেক প্রহেলিকাই আমরা সাধারণ ভাষা দিয়ে বুঝতে বা বোঝাতে পারি না, তাদের অনেকটাই বোঝা যায় গণিতের ভাষা দিয়ে। আগেই বলেছি, কবিতা ও গণিতের ধর্ম ও চরিত্র এক নয়। কিন্তু এই আপাত অমিল সত্ত্বেও তাদের পরস্পরের মধ্যে রয়েছে এক গভীর যোগাযোগ, এক বর্ণাঢ্য সেতুবন্ধন। আসলে, প্রকৃত কবিতা আর বিশুদ্ধ গণিত– উভয়েরই স্বভাবধর্মের মধ্যে নিহিত রয়েছে একপ্রকার অধিবিদ্যিক (metaphysical) লক্ষণা। গণিতের বচনেরা হলো সেইসব বিস্ময়কর ভাষ্য, যারা একইসঙ্গে সংশ্লেষী ও বিশ্লেষী; যারা অভিজ্ঞতা-সাপেক্ষ, আবার একইসঙ্গে অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষও বটে; যারা একইসঙ্গে পূর্বতঃসিদ্ধ (a priori) এবং পরতঃসাধ্যও (posteriori); যারা আমাদের নতুন জ্ঞান দেয়, এবং একইসঙ্গে দেয় জ্ঞানের সুনিশ্চয়তাও (অর্থাৎ দেওয়া জ্ঞানকে কনফার্মও করে)। গণিত ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না এ ধরনের অধিবিদ্যক লক্ষণাযুক্ত ভাষ্য। এখানেই গণিতের কৃতিত্ব, মহত্ত্ব ও মির্যাকল ।
উদাহরণ দিলে কিছুটা ফর্সা হবে। “বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে”, “আলোর গতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার” কিংবা “রোম যখন পুড়ছিল, সম্রাট নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল” কিংবা “গাছ থেকে ফল মাটিতে পড়ে” এসব বাক্য স্বভাবে সংশ্লেষণধর্মী, অভিজ্ঞতাসাপেক্ষ এবং পরতঃসাধ্য। এসব বাক্য নতুন জ্ঞান দেয় বটে কিন্তু সে-জ্ঞানের সুনিশ্চয়তা দেয় না। অভিজ্ঞতা দিয়ে বারংবার পরখ করে এদের সত্যাসত্য যাচাইয়ের মাধ্যমেই কেবল জ্ঞানের সুনিশ্চয়তা পাওয়া সম্ভব। পক্ষান্তরে, “অন্ধ লোক চোখে দ্যাখে না” কিংবা “সমবাহু ত্রিভুজ একটি ত্রিভুজ” কিংবা “অকৃতদারের বউ নেই” এ ধরনের বাক্য বিশ্লেষণধর্মী, অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ ও পূর্বতঃসিদ্ধ। এরা নতুন কোনো জ্ঞান দেয় না, তবে দেওয়া জ্ঞানের সুনিশ্চয়তা দেয়।
কিন্তু এমন কোনো বাক্য কি সম্ভব যা একইসঙ্গে অভিজ্ঞতাসাপেক্ষ ও অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ, পূর্বতঃসিদ্ধ এবং পরতঃসাধ্য, এবং একইসঙ্গে নতুন জ্ঞান দেয় আবার সেই জ্ঞানকে কনফার্মও করে? দেখা গেল, একমাত্র গণিতেই সম্ভব সেরকম বাক্য বা বচন।
“২ + ২ = ৪” কিংবা “দুইটি সরলরেখা কোনো স্থানকে (space) সীমাবদ্ধ করে না”– এ ধরনের গাণিতিক বচন একইসঙ্গে অভিজ্ঞতাসাপেক্ষ ও অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ; পূর্বতঃসিদ্ধও, আবার পরতঃসাধ্যও। বচনগুলিকে বস্তু, স্থান ইত্যাদি দিয়ে বাস্তবে পরখ করে দেখলেও সেগুলি সত্য, না দেখলেও সত্য। অর্থাৎ, কোনো বস্তু বা স্থানের অস্তিত্ব থাক বা না থাক, বচনগুলি সত্য– বস্তু-স্থান-কাল-অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষভাবে সত্য। আবার অভিজ্ঞতা দিয়েও প্রমাণ করা যায় ওগুলির সত্যতা।
অর্থাৎ গণিতের বচনেরা একদিকে অভিজ্ঞতাসাপেক্ষ বা পরতঃসাধ্য, নতুন জ্ঞান দেয়; একইসঙ্গে তারা পূর্বতঃসিদ্ধ বা অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ, তাই তারা দেয় সেই জ্ঞানের সুনিশ্চয়তাও। গাণিতিক বচনগুলি আসলে যুগপৎ নতুন জ্ঞান ও তার নিশ্চয়তা প্রদানকারী এক-একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষ্য।
একটি কবিতা, বা যে কোনো শিল্পকর্ম, বিকশিত হতে হতে, উৎকর্ষের দিকে যেতে যেতে, এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় ওরকম বিশুদ্ধ গণিতের দশায়। তখন কবিতা হয়ে ওঠে গণিতের মতো মেটাফিজিক্যাল, যুগপৎ সংশ্লেষী ও বিশ্লেষী; হয়ে ওঠে একইসঙ্গে অভিজ্ঞতাসাপেক্ষ ও অভিজ্ঞতানিরপেক্ষ, পূর্বতঃসিদ্ধ ও পরতঃসাধ্য।
কবিতা হয়তো প্রথাগত নতুন জ্ঞান দেয় না, তবে সে যা দেয় তা হলো নতুন সৌন্দর্য, নতুন রস, চিত্তের জন্য নতুন আনন্দ, যা পাঠককে করে তোলে মুগ্ধ, বিস্মিত ও বিহ্বল। বলা বাহুল্য, সেই বিস্ময়বিহ্বলকর নতুন রস, নতুন সৌন্দর্য প্রকারান্তরে নতুন ‘জ্ঞান’ও বটে। শুধু তা-ই নয়, গণিতের মতো করেই তা আবার একইসঙ্গে দিয়ে দেয় সেই সৌন্দর্য ও আনন্দের সুনিশ্চয়তাও। এখানেই প্রকৃত কবিতা বা শিল্পকর্মের রহস্য।
এই সেই প্রচ্ছন্ন সূত্র ও সেতু, কবিতা ও গণিতের মধ্যকার।
সূত্র: বিনয় মজুমদার, ইমানুয়েল কান্ট।