বধির যে ভাষা, বোধের দিকে – নাহিদ ধ্রুব
অর্থ কি ভাষার দিকে যায়? নাকি ভাষা অর্থের দিকে? এই শীর্ষক আলোচনা করতে গিয়ে একদিন খুব ভাষাবিভ্রাট হলো আর তখন আমরা নৈশব্দে অনুসন্ধান করছিলাম অর্থ। তখন হাওয়া বইছিল মৃদু, মনে হচ্ছিল এক সর্বহারা নদী যাকে লাগছে মুমূর্ষু আকাশের মতো। আমরা এই বোধকে যখন ভাষায় টেনে আনি তখন সেটার যে অন্তর্নিহিত অর্থ প্রকাশ পায় সেটা কি ভাষার গুণাগুণ নাকি স্রেফ বোধ? একটা বাক্য নিয়ে চিন্তা করা যাক, ধরা যাক বাক্যটি মধুর কিন্তু শব্দের ব্যবহারে তার মধ্যে জন্ম নিয়েছে রুক্ষতা। অথচ, ভাবের কোন রদবদল হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে আমরা কি স্রেফ কমিউনিকেশনে জোর দিবো নাকি বাক্যটিকে করে তুলবো শ্রুতিমধুর?
সময়ের সাথে সাথে ভাষা এবং বোধের মধ্যে তৈরি হয় বিস্তর ফারাক। যদিও আমরা দাঁড়িয়ে থাকি একটা নির্দিষ্ট সাঁকোয়। নবম শতাব্দিতে যে বাংলা সাহিত্যের সূচনা কিংবা চর্যাপদে যে হাতেখড়ি তার সূত্র ধরে অষ্টাদশ শতাব্দিতে যে আধুনিক সাহিত্যের সূচনা হয় সেখানে আছে ভাষার বিস্তর ফারাক। আসে সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে আলাদা স্তর। সাহিত্যিকরা পূর্বের ধর্মীয় বিষয়বস্তুর বদলে মানুষ, মানবতাবাদ ও মানব-মনস্তত্ত্ব নিয়ে সাহিত্যের দিকে বিশেষভাবে ঝুঁকে পড়ে। এমনকি আধুনিক সাহিত্যেও ভাষার যে ট্র্যান্সফরমেশন সেটা উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্র পরবর্তী জীবনানন্দের ভাষা বাংলা কবিতায় এক অভূতপূর্ব মোড় বলাই বাহুল্য। এসব ইতিহাস টানছি এটা বুঝাতে যে ভাষা কখনই স্থির নয়। ভাষা বিভিন্ন সিন্ট্যাক্সে , বিভিন্ন ক্রাফটে ব্যবহৃত হয়ে নতুন কোন কবিতার সন্ধান দিতে পারে। আজ আমরা যে ভাষা, যে ইমেজ কিংবা যে কালের বর্ণনা দিচ্ছি বাংলা কবিতায় আগামী কয়েক দশক বাদে তেমন থাকবে এমন আমি বিশ্বাস করি না। আমরা সকলেই অনুভূতির চাষ করি আদতে কিন্তু সে অনুভূতির প্রকাশ যে ভাষায় আমরা করে থাকি সেটা কমন। তো, আমাদের এই যে সামগ্রিক অনুভূতি এটার পথ বাতলে দেয়ার জন্য ভাষার কোন বিকল্প নেই।
ভাষার প্রকরণ যেমন কালের সাথে বদলে যায় তেমন বদলাতে পারে বিশেষণ । ভাষার বিশেষণ অবশ্যই ভাষার পালস মেইনটেন করে বলে আমার বিশ্বাস। কবিতায় কি শুধু ভাষাই একজন কবিকে কালজয়ী করতে পারে? না, আমার তেমন মনে হয় না। তবে, স্বকীয় স্বর ছাড়া একজন কবি নিশ্চয়ই অস্তিত্ব সংকটে ভোগে এমন ধারণা করি। বাংলা কবিতায় যুগে যুগে অসংখ্য ভালো কবিতা লেখা হয়েছে এবং আগামীতেও লেখা হবে। পাঠকের মুখে মুখে যে সব কবিতার জয়জয়কার সেগুলোই সার্থক কবিতা এমন আমি বিশ্বাস করি না । একটি ভালো কবিতা লেখা তেমন বড় ঘটনা না , বলা যেতে পারে একটি নতুন কবিতা লেখাই গুরুত্বপূর্ণ। নতুন কবিতা কে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবো সেটা আমি জানি না। তবে, নতুন কবিতা হতে পারে এমন একটা কিছু যা বারবার কবিতার একঘেয়েমি কাটিয়ে পাঠককে ফিরিয়ে নেবে কবিতায়।
বাংলা কবিতায় অসংখ্য রদ বদলের মধ্য দিয়ে এখন এই সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখান থেকে কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হলে খুব জটিল এক সমীকরণের মধ্য দিয়ে যেতে হবে বলাই বাহুল্য। তবুও, প্রচণ্ড ইমেজের ব্যবহার থেকে মানবিক বোধ, বিষণ্ণতা এবং প্রকৃতির পোস্টমর্টেম করে যে সব সার্থক কবিতা লেখা হয়েছে সেখান থেকে বাংলা কবিতায় এসেছে বিবৃতিমূলক বয়ানধর্মী কবিতা। এসেছে আইডিয়া বেইসড কবিতা। সকল শাখায় কালজয়ী কবিদের পদচারনা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে তারপর কি? আমরা কি ভাষার দিকে যাবো নাকি অর্থের দিকে? এই আলোচনা অনেক জটিল।
কবিতায় বাস্তবিক অলংকারের অভাব কবিতার বোধ কে পলকা করে দেয় বলেই আমার বিশ্বাস। উল্লেখ্য, জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজের উদাহরণ টানা যেতে পারে। হেলাল হাফিজ যথেষ্ট জনপ্রিয় কমিউনিকেটিভ কবিতা লেখা সত্ত্বেও আমি মনে করি বাংলা সাহিত্যে তার অবদান অতি নগণ্য। এমন অবস্থানের পেছনে তার ভাষার দুর্বলতাকে দায়ী করতে পারি কিংবা বলা যেতে পারে তিনি একটা নির্দিষ্ট মহলকে আমোদিত করতে পারলেও তার বক্তব্যের দক্ষতায় রয়ে গেছে সামগ্রিকতার অভাব। যেখানে জীবনানন্দ, বিনয় কিংবা আল মাহমুদ, সৈয়দ হক সহ অসংখ্য কবি আছেন যারা নিজের ভাষাগুণে প্রভাবিত করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। একজন কবি অসংখ্য কবির দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন, এবং এই প্রভাব থাকা অবশ্যই ভালো কবির লক্ষণ আমার মনে হয়। মূল বিষয় হচ্ছে এই প্রভাবকে গিলে ফেলে যে কবি নিজের স্বর খুঁজে পান তাকেই সার্থক কবি বলতে আমি পছন্দ করি। যে কবি নিজের স্বর খুঁজে পান তিনি অবশ্যই নতুন কবিতার সন্ধান দিতে পারেন।
মোদ্দাকথা, আমার মনে হয় বাংলা কবিতায় বিবৃতিমূলক এবং বিশ্লেষণ ধর্মী কবিতার (মেদের প্রাচুর্য এবং প্রচুর অপ্রয়োজনীয় রিপিটেশন) তেমন মূল্য এখন আর নেই। কবিতায় অলংকরণের বাইরেও ভালো অসংখ্য কবিতা হতে পারে, আইডিয়া বেইসড কবিতায় যদিও আছে ভিন্নতা। উদাহরণ টানতে গেলে সাম্প্রতিককালে ইমতিয়াজ মাহমুদের কথা বলতে হয়। তার কবিতায় অলংকরণের চেয়ে বক্তব্য প্রধান হলেও তার নিজস্ব সাবলীল ভাষা এবং প্রকাশভঙ্গী তাকে আলাদা করে দেয় অন্য অনেকের চেয়ে। এটাকে নতুন কবিতা বলা যায়। অর্থাৎ, ভাষাই মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নয় যদি আপনার বক্তব্য হয় সুস্পষ্ট।
আমি বিশ্বাস করি কমিউনিকেটিভ কবিতা সবসময় নন-কমিউনিকেটিভ কবিতার চেয়ে এগিয়ে থাকবে। যদিও কবি যে কোন ভার্স কে নিজের মতো বিশ্লেষণ করতে পারেন তবুও, যদি একটি কবিতার প্রতি চরনে আপনাকে যেতে হয় অতিকল্পনার কাছে তাহলে সে বয়ান নিতান্তই ঝাপসা হয়ে ওঠে। আমরা যে জীবনটা যাপন করছি সেটাই কি বহুলাংশে পরাবাস্তব নয়? পরাবাস্তব ইমেজের প্রাচুর্য আনতে হলে আমরা তাই কিছুতেই আমাদের বাস্তবতা কে অস্বীকার করতে পারি না। ভাষার মাধুর্য যাই হোক না কেন সেটা যদি অনর্থক বোধের জন্ম হয় তবে সে নিদারুণ শৈল্পিক ভাষার কাজও হতে পারে এক নিতান্ত ব্যর্থ প্রচেষ্টা। আমরা অবশ্যই ভাষা দিয়ে আমাদের কল্পনাকে স্টাব্লিশ করবো এবং সেটা ক্রমেই বিমূর্ত থেকে হয়ে উঠবে মূর্ত এমনটাই বিশ্বাস করি বর্তমানে।
স্পষ্ট বক্তব্য এবং নিজস্ব ভাষার দক্ষতা কবিতাকে নতুন আঙ্গিক দেয়। সেখানে যোগ দেয় কবিতার সমগ্রিক টুলস। একটা কবিতা ভার্সে, ফ্রি ভার্সে, টানাগদ্যে, ছন্দে হতে পারে যদি সেটা ভালো কবিতা হয়। ভালো কবিতা এবং খারাপ কবিতাকে আলাদা ভাবে বিশ্লেষণে যেতে চাই না, কেননা সেটা ম্যান টু ম্যান ভ্যারি করতে পারে। তবে, এটা বিশ্বাস করি যেটা ভালো কবিতা সেটা সার্বজনীন ভালো কবিতা তাকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা সচেতন পাঠকের নেই। কবিতার মেলোডি, টিউনিং, মেকিং একটা কবিতার পুরো ভিত্তি কে পাল্টে দিতে পারে । সেক্ষেত্রে লিনিয়ার, অ্যাবস্ট্রাক্ট, ন্যারেটিভ কিংবা সাররিয়াল আপনি যাই লিখুন না কেন সেটাও হতে পারে কালজয়ী রচনা। দিন শেষে কবিতাকে ভাষা এবং অর্থ ছাপিয়েও কবিতাই তো হয়ে উঠতে হয়!
আমার মনে হয় একজন কবির প্রচুর লেখা উচিৎ, এবং অবশ্যই প্রচুর খারাপ কবিতা লেখা উচিৎ। কবিতা নিয়ে করা উচিৎ যাবতীয় এক্সপেরিমেন্ট। অনেকটা নেটে বল করার মতো। আপনি বিভিন্ন জায়গায় হিট করলেই কেবল মাত্র খুঁজে নিতে পারবেন আপনার নিজস্ব জায়গা। আর এই নিজস্ব জায়গা হচ্ছে কবির স্বকীয় স্বর। স্বকীয় স্বর ধরেই আসবে অর্থপূর্ণ ভাষা আসবে নতুন ব্যাঞ্জনা, নতুন দ্যুতি। আর নতুন ভাষার ব্যবহার ছাড়া আদতে প্রচুর ভালো কবিতাও ভেসে যেতে পারে কালের স্রোতে। কবি শুধুমাত্র নিজের টেক্সটে বেঁচে থাকে , ফরমায়েশি পাঠকের মনে বেঁচে থাকে না। সে অন্য আলোচনায় অন্য কোন কালে অন্য কোন তালে সুর আরোপ করবো না হয়। আপাতত, ভাষাকে টেনে নিয়ে যাওয়া যাক অর্থের দিকে।