চিমিচাঙ্গা থেকে হিমালয় – মাহরীন ফেরদৌস

মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তনশীল এই পৃথিবীতে কিছু বিষয় থাকে বেশ নিয়মমাফিক। খুব সম্ভবত পৃথিবী এদিক থেকে সেদিক হয়ে গেলেও সেই বিষয়ের পুনরাবৃত্তির কোন ব্যাঘাত ঘটবে না। যেমন, প্রতিমাসে অন্তত এক বা দু দিন সকাল সকাল আমার মুঠোফোনে একজনের ম্যাসেজ আসা। প্রথম ম্যাসেজটিতে শুধু একটি শব্দ লেখা থাকবে। তা হল,

‘বনিতা…’

এই এক শব্দেই আমি বুঝে যাব, এই যাহ! পাঁচ নাম্বার বিপদ সংকেত বেজে গিয়েছে। আজকের দিনলিপি আর আমার হাতে নেই। এই ম্যাসেজ দেখে ফেলা মাত্রই আরও একগাদা ম্যাসেজ আসতে শুরু করবে এবং নিশ্চয়ই আজ রাতে সে আমার বাসায় আসবে। এমতাবস্তায়, মনে মনে প্রমাদ গুনতে গুনতে উত্তর দেব,

– হ্যাঁ, বল।

– আজকে রাতে কি আমি তোমার বাসায় আসতে পারি? আমি একটা নতুন খাবার রান্না করতে চাই। খুব মজা। তোমাকে কিছুই করতে হবে না। আমি সব উপকরণ নিয়ে আসব। শুরু রান্না করব তোমার বাসায়। তারপর তুমি, আমি এবং শৈশব একসাথে রাতের খাবার খাব? কী দারুণ হবে তাই না বনিতা?

প্রায় মুখস্থ হয়ে যাওয়া এই কথাগুলো শুনে আমি মনে মনে খাঁটি বাংলায় বলব ‘মারছে আমারে’! তারপর কণ্ঠস্বর খুব স্বাভাবিক রেখে উত্তর দেব,

– ইয়ে মানে, আজকে আমি একটু ব্যস্ত।

– তাহলে কালকে? আমি রাত আটটার পর একদম ফ্রি। কালকে আসব?

– কাল কে আমি কিছু কেনাকাটা করতে যাব সন্ধ্যায়।

– তাহলে পরশু আসব? পরশু তো ছুটির দিন। লম্বা সময় থাকতে পারব তোমার সাথে। ফোনের ওপাশের মানুষটি কিছুতেই দমে যাওয়ার মত নয়।

ছুটির দিনে লম্বা সময়ের কথা শুনে রীতিমত আতংকিত হয়ে আমি বলতে বাধ্য হব, না, থাক। তুমি কালকেই আস। আমি বরং পরশু কেনাকাটা করতে যাব। কাল সন্ধ্যায় চলে এস।

– কাল দেখা হচ্ছে তাহলে। আমি কাল তোমাদের ‘তামালেস’ বানিয়ে খাওয়াব।

এই কলটা আসলে আমি আর হাঁফ ছাড়তে গিয়েও পারি না। চোখের সামনে সিনেমার দৃশ্যের মত দ্রুতগতিতে ভেসে ওঠে, আগামীকাল বিকেলে সে আসবে। প্রথমে দু থেকে তিন ঘণ্টা আমাকে ইউটিউবে তাদের দেশের নানা খাবার, উৎসব এবং দর্শনিয় স্থানের ভিডিও দেখতে হবে। এরপর সে ঘণ্টাদেড়েক রান্নাঘরে গিয়ে তার দেশীয় কোন খাবার রান্না করবে। সেই রান্না খেতে হয়ত খুব ভালো হবে নয়ত খুব খারাপ। মাঝামাঝি কিছু হবে না। আজ পর্যন্ত মাঝামাঝি স্বাদের কিছু সে রান্না করতে পারে নি। তার সবকিছুই অতিরিক্ত ভালো নইলে মন্দ। তারচেয়েও বড় ব্যাপার হল, খাওয়া দাওয়ার মাঝে সে অসম্ভব সরল চেহারা করে, জুলুজুলু চোখে খাবার সম্পর্কে মতামত জানার জন্য আমার দিকে আগ্রহ ভরে তাকিয়ে থাকবে। আমরা বাঙালিরা আমেরিকানদের মত অনেক কথা সরাসরি বলতে পারি না বলে যত খারাপই হোক মুখে সেটাকে ভালো বলব। এরপর মতামত পেয়ে খুশি হয়ে সে গল্প করতে করতে বলবে ‘এই তো বাসায় চলে যাচ্ছি’, ‘অনেক রাত হল’, ‘আবার দেখা হবে’ কিন্তু তারপরেও এসব বলতে বলতে প্রায় মধ্যরাতের পর বিদায় নিবে। এমন ঘটনা এবারই প্রথম হবে তা কিন্তু নয়, মাসখানেকের পর পর আমাদের সাথে এটাই ঘটে যাচ্ছে।

বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসার মায়াজালে জড়িয়ে যে মানুষটি প্রায়ই আমাকে এভাবে ধরাশায়ী করে ফেলে সে হল আমার এক মেক্সিকান বান্ধবী। প্রতি সপ্তাহের সোম থেকে শুক্র সে কাজ করে। শুক্রবার রাতে মেক্সিকান ক্লাবে যেয়ে অল্প বিস্তর পান করে আর বন্ধুবান্ধবি ও স্বামীর সাথে চিৎকার করে গান গাইতে গাইতে নাচে। সবাই নাকি বলে ওর গানের গলা চমৎকার, যদিও আমার কাছে খুব ভয়াবহ লেগেছে। রীতিমত ‘চিল্লানোশ্বর’। শনিবারে সাপ্তাহিক বাজার করে এবং রবিবার সকালে সেজেগুজে চার্চে গিয়ে প্রার্থনা শেষ করে আমাকে ম্যাসেজ পাঠায়। সাপ্তাহিক এই নিয়মের বাইরে প্রতি মাসে এক কিংবা দু দিন তার আমাকে ও শৈশবকে মেক্সিকান খাবার খাওয়ানোর পোকা উঠে, এরপর সে রীতিমত উঠেপড়ে লেগে যায় আমার বাসার আসার জন্য। কোন উপায়েই তাকে আর দমানো যায় না।

বিগত দেড় বছরে আমেরিকায় আমার নানা দেশের, সংস্কৃতির মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হলেও ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব ও পরিচয়পর্বটি ছিল বেশ মজার।

গত বছরের শুরুতে শৈশব আমেরিকা যাওয়ার দু’সপ্তাহ পর একদিন আমাকে স্কাইপে কল করে জানাল অবশেষে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনিয়র ভাইয়ের বাসায় বাঙালি খাবারের দাওয়াত পেয়েছে। সপ্তাহের শেষে সে দাওয়াত খেতে যাবে। আমি তখন বাংলাদেশে। বইমেলায় বই প্রকাশের সময় উপস্থিত থেকে, চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে তারপর আস্তে ধীরে আমেরিকা যাব বলে পরিকল্পনা করছিলাম। সেদিন ওর দাওয়াতের কথা শুনে আমি যারপরনাই খুশি হয়ে বললাম, যাক। আজ তাহলে বাঙালি খাবারে ভালো ভুড়িভোজ হবে তোমার!

কথা শুনে শৈশব আনন্দে দাঁত বের করে ফেলল। দেশের বাইরে যাওয়ার দুই সপ্তাহের মাঝে যে কোন জায়গায় বাঙালি খাবার খাওয়ার দাওয়াত যে কতটা অমূল্য তা দেশ না ছাড়লে পৃথিবীর কেউ বুঝতে পারবে না।

কাঙ্ক্ষিত দাওয়াতের দিন আমি জানতে পারলাম সেই দাওয়াতে শৈশব বাদেও একটি মেক্সিকান মেয়ে আসছে যে কিনা সিনিয়র ভাই ও ভাবীর পরিচিত। এইটুকু শোনামাত্রই আমি নড়েচড়ে বসলাম। মেক্সিকান  মেয়ে শুনলেই কেন যেন মনে হয় বাদামি গায়ের রঙ আর কাল কিংবা গাঢ় বাদামি চুলের ছিপছিপে কোন সুন্দরীর কথা। চোখে ভেসে উঠল সালমা হায়েক কিংবা লোরেনা রোহাসের চেহারা।

খুব আগ্রহ নিয়ে বললাম, সুন্দরীর ছবি পাঠিও তো।

নির্দিষ্ট দিনে দাওয়াতে পৌঁছে শৈশব জানাল, দেখ, আমি হুট করে অচেনা কোন মেয়ের ছবি তুলে পাঠাতে পারব না। ভিডিও কল দেই, আমার সাথে কথা বলার ফাঁকে নিজেই দেখে নাও।

ভিডিও কলে মেক্সিকান সুন্দরীকে দেখে আমি ভিমরি খেলাম। কম করে হলেও শ’ কেজি ওজন তো তার হবেই। গালগুলো ফুলো ফুলো বেলুনের মত। চুল সোনালি। বেশ কড়া মেকআপ দেওয়া মুখে। এই সৌন্দর্যের বিশালতায় একবার চাপা পড়লে হারিয়ে যেতে পারবে যে কেউ। আর ফিরে আসবে না।

সুন্দরীকে দেখে  আমি আমার কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে মেলবন্ধন ঘটাতে ঘটাতে খাঁটি বাংলায় বললাম,

– খাইছে!

তবে এই ‘খাইছে’ সুন্দরী যে আর অল্প কয়েকমাস পর ভিনদেশে আমার অত্যন্ত কাছের বান্ধবী হয়ে যাবে তা আমার জানা ছিল না। আমেরিকা আসার কয়েকমাস পর যখন আমার এই সুন্দরীর সাথে পরিচয় ঘটে সে আমাকে আচমকা হকচকিয়ে দিয়ে বাংলায় বলে ওঠে,

– কেমন আসো?

আমি হকচকানো ভাব সামলাতে সামলাতে বলি,

– ইয়ে মানে ভালো।

সে প্রবলভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে ইরেজিতে বলে, তুমি ঠিকমত উত্তর দিতে পারো নি মেয়ে। তোমাকে বেঙ্গলিতে বলতে হবে,
– আমি ভালোয়াসি।

এবার উত্তর শুনে আমি হাসতে শুরু করি। প্রথম পরিচয়ে তার ভাষাজ্ঞান সত্যি আমাকে মুগ্ধ করে ফেলে। সেই থেকে শুরু হয় আমাদের বন্ধুত্ব। অতিশয় বিশাল এই মেক্সিকান সুন্দরীর নাম ‘আনা’। সে আমাকে ভালোবেসে ডাকে ‘বনিতা’ অর্থাৎ সুন্দরী।

দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরের এই আমেরিকায় যারা খুব দ্রুত আমাকে আপন করে নিতে পেরেছিল তাদের মধ্যে আনা অন্যতম। তার ওজনে সম্পর্কে আগেই বলেছি। এবার বাদ বাকি উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলি। আনার বয়স একত্রিশ। সে বেশ বিশাল একটা লাল ট্রাক চালায়। এই ট্রাক চালিয়ে সে সারা শহর ঘুরে বেড়ায়। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম সে অবিবাহিত। পরে জানতে পেরেছি তার আট বছর বয়সী একটি ছেলে আছে যার নাম ‘অ্যালেক্স’। তার স্বামীও আছে। যদিও তার বর্তমান স্বামীটি অ্যালেক্সের জন্মদাতা পিতা নয়। তবে এই সত্যটি এখনও ওর সন্তানটি জানে না। আঠার বছর বয়স হবার পরই তাকে জানানো হবে। এর আগে নয়।

আমি জানতে চাই, অ্যালেক্সের আসল বাবা কোথায়?

আনা জানায়, যখন যে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা তখন যে জানতে পারে তার স্বামীর আরেকটি পরিবার আছে। সেই পরিবারে স্ত্রী, সন্তান সবাই আছে। অথচ ও এসবের কিছুই আগে জানত না। এই ঘটনার পর সে তার স্বামীকে ছেড়ে দেয়। অ্যালেক্স জন্ম নেয় তার খালার পরিবার ও কিছু বান্ধবীর সাহায্যে। এরও কয়েকবছর পর তার পরিচয় হয় বর্তমান স্বামীর সাথে। দুজনে একে অন্যকে ভালোবেসে সিদ্ধান্ত নেয় একসাথে থাকার। এই কথাগুলো শুনে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, পৃথিবীর সব দেশেই কি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে নাকি? ঠিক এমন এক ঘটনা তো আমার এক বান্ধবীর সাথে ঘটেছিল। বিবাহিত, এক সন্তানের জনক সেই ভদ্রলোক নিজেকে ডিভোর্সড বলে পরিচয় দিয়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিল বান্ধবীটির সাথে। আহা! প্রতারণার তাহলে কোন দেশ নেই, ভাষা নেই, জাতিও নেই।

আনা দীর্ঘ বারো বছর ধরে আমেরিকায় বসবাস করলেও মূলত গত বছর পর্যন্ত তার কোন নাগরিকত্ব কিংবা আইনি অনুমতি ছিল না এখানে থাকার। অ্যালেক্স জন্মসূত্রে আমেরিকান কিন্তু ও নয়। আনার স্বামী খুব অল্প কিছুদিন হল কাজ করার অনুমতিপত্র পেয়েছে, বর্তমানে ওরা স্বামী-স্ত্রী দুজনাই নাগরিকত্বের আবেদন করেছে।

প্রবাসে আমার সংসার শুরুর ভালো মন্দ অনেক ঘটনার  সাথে  শুরু থেকেই কেন যেন এই মেয়েটি বেশ জড়িয়ে গিয়েছিল। যেমন, গত বছরের শুরুর দিকে আমাদের এপার্টমেন্টে কোন আসবাবপত্র ছিল না। নতুন আসবাবপত্রের চড়া দাম দেখে খুব ভাল করেই বুঝে গিয়েছিলাম সেগুলো কেনার সামর্থ্য বা ইচ্ছে কোনটাই আমাদের নেই। তাই পুরানো আসবাবপত্রের দোকান, ক্রেগলিস্ট, এবং ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে দামাদামি করে আমরা বেশ কিছু জিনিস কিনেছিলাম। সেগুলো নিয়ে আসার জন্য গাড়ি ভাড়া করতে যাওয়ার খবর শুনলেই ক্ষেপে যেত। আর বলত, শুধু শুধু টাকা নষ্ট করো না। এরপর সে তার সুপার ট্রাক নিয়ে হাজির হয়ে যেত। আমার বাসার  বেশ কিছু  আসবাবপত্র  আছে  যা  শুধু  ওর সাহায্যের কারণেই  আমরা  বেশ দ্রুত  কিনে ফেলতে পেরেছিলাম।

আনা মানুষ হিসেবে কেমন তা নিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা আছে,

গত বছরের মাঝামঝির এক রাতে আমার বাসায় আসার পথে সে একটি বাইক দুর্ঘটনা দেখেছিল। দুর্ঘটনা দেখামাত্রই এখানে ৯১১ এ ফোন করে দেওয়ার নিয়ম, কিন্তু ও এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে রাস্তায় তৎক্ষণাৎ গাড়ি থামিয়ে থরথর করে কাঁপছিল। কাঁপা কাঁপা হাতে ৯১১ কে ডায়াল করার আগেই পাশ এক পথচারী জানিয়েছিল সে ইতিমধ্যেই কল করেছে। আনা যেন দ্রুত ওর ট্রাক সরিয়ে ফেলে। ইমার্জেন্সির গাড়ি আসছে। রাস্তা আটকে রাখা যাবে না। কোনরকমে গাড়ি চালিয়ে আমার বাসায় এসে কাঁপতে কাঁপতে আমাকে পুরো ঘটনা বলেছিল। পরের দিন আমরা জানতে পেরেছিলাম উইচিতা ষ্টেট ইউনিভার্সিটির একজন সুপরিচিত ভারতীয় প্রফেসর গতরাতে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। তিনি এখন হাসপাতালে। এবং তার অবস্থা খুবই বিপদজনক। রাস্তায় মেরামতের কাজ চলছিল এবং সঠিক নির্দেশনা দেওয়া ছিল না বলে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ প্রমাণ এবং প্রতক্ষদর্শী খুঁজছে। আমি আনাকে ফোন করে বিস্তারিত জানাতেই সে বলেছিল, আমি পুলিশের কাছে সাক্ষী দিতে চাই।

গত বছরের সে সময় আনার কিংবা ওর স্বামীর কোন আইনি কাজগপত্র ছিল না। সাধারণ পুলিশের যদিও ভিসা কিংবা কাজের অনুমতির কাগজ দেখতে চাওয়ার কথা না তবুও চট করে সাক্ষী হতে চাওয়ার সাহসিকতাটুকু আমাকে বিস্মিত করেছিল। আমি শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম ওর স্বামী ওকে সাক্ষী হবার অনুমতি দেবে না, যে কেউই আইনি জটিলতা এড়াতে চায়, কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন স্বামীকে রাজি করিয়ে ও পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সাক্ষ্য দিয়ে এসেছিল। তারপর সেদিন বিকেলেই আমাদের সাথে হাসপাতালে ছুটেছিল সেই প্রফেসরকে দেখতে। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়া প্রফেসরের স্ত্রীর হাত ধরে যখন আমি ওকে কাঁদতে দেখি তখন মেয়েটিকে আমি প্রচণ্ড মানবিক বলব নাকি আবেগী বলব তা আমি ভেবে বের করতে পারি নি।

বাংলাদেশ, ভাষা এবং সংস্কৃতি নিয়ে আগ্রহ আমি অনেক বিদেশীর মাঝেই দেখেছি, কিন্তু আনার মত এভাবে কাউকে এত দ্রুত ধারণ করতে দেখি নি। সেটা স্কার্ট আর গেঞ্জির উপর শাড়ি পরা হোক, চিকেন বিরিয়ানি খাওয়ার আকুলতা হোক কিংবা বাংলাদেশে যেয়ে রিকশা করে ঘোরা নিয়েই হোক না কেন।

কেউ যদি ওকে প্রশ্ন করে বাংলাদেশের সকালের নাস্তা সাধারণত কী হয়?

সে তৎক্ষণাৎ বাংলায় বলে দিবে, পরাটা, আলু বাজি, দিম ভাজি, চা।

বাংলাদেশের খাবার খাওয়ার এবং আমাকে মেক্সিকান খাবার খাওয়ানোর বিষয়ে ওর কোন ক্লান্তি নেই। একবার সে রান্না করল মেক্সিকোর বিখ্যাত খাবার চিমিচাঙ্গা। আমি আগ্রহ নিয়ে খেয়ে বুঝলাম এই খাবার আমার খাওয়া সম্ভব না। অবস্থা বুঝে একটু চুপ করে আমি বললাম, এখন একটু টেস্ট করলাম। আবার পরে খাব। ঠিক আছে?

আমার উত্তর শুনেই এবার আনা জ্বলজ্বলে চোখে শৈশবকে বলল, তোমার কেমন লেগেছে?

শৈশব হাসি হাসি মুখে বলল, খেতে জঘন্য হয়েছে মানে ভেরি টেস্টি!

আনা প্রবল উৎসাহ বলল, না না, বাংলা বল ইংরেজিতে বল না। আমি গুগল ট্রান্সলেটর থেকে বের করে নিচ্ছি। এভাবে আমি আরও বাংলা শিখতে পারব আর বুঝতে পারব। শৈশবের ততক্ষণে মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। ঢোঁক গিলে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য সে কথা ঘুরিয়ে বলল, খেতে চমৎকার হয়েছে এটা বলেছিলাম। এটা লিখে সার্চ দাও।

আমি ততক্ষণে হাসি চেপে আকাশ বাতাস দেখছি। আর আনা হামলে পড়েছে গুগল ট্রান্সলেটরে।

তবে ডেভিল শির্ম্প, গ্রিন ইঞ্চিলাডা, তোসতাডাস এবং মেক্সিকান তাকোসহ নানা রকমের মজার খাবারও সে আমাদের রেঁধে খাইয়েছে। দীর্ঘ বারো বছর আমেরিকায় থেকেও সে হয়ত এখানকার মানুষদের মত হয়ে উঠতে পারে নি। আর সে কারণেই তার কার্যক্রম আমার কাছে নাছোড়বান্দা বাঙালিদের মতই মনে হয়। অনেকটা নাটক, সিনেমার যন্ত্রণাদায়ক প্রতিবেশীর গল্পের মত। বাড়িতে আসতে যেতে যাদের সাথে দেখা হবে, জোর করে যারা মেহমান হবে, জোর করে নিজেদের বাসায় মেহমান বানাবে কিন্তু নাটকের শেষে দেখা যাবে যে সেই প্রতিবেশী অবুঝ, এবং নিখাদ ভালোবাসা থেকে এতদিন এই কাজগুলো করেছে। সব জেনে তখন বিরক্তির বদলে মায়া বেশি কাজ করবে।

যাই হোক, এবার একটি বিশেষ ঘটনা বলি,

আমাদের দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকীর সকাল থেকে আমার অত্যন্ত মন খারাপ ছিল। বিবাহের মাস ছয়েক পরই প্রবাসে চলে এসেছি। বিগত দেড় বছরে যে কোন উল্লেখযোগ্য উৎসব এবং দিনে ঘুরে ফিরে শুধু দেশের কথাই মনে হয়েছে। এবং সেই মনে হওয়ার আকুলতা অন্যান্য সব বিশেষ অনুভূতিকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে ঢেকে ফেলেছে। এমন অবস্থায় সবকিছুই খুব আনন্দহীন মনে হচ্ছে। দিন কেটে গেল যেমন তেমন করে, কিন্তু রাত বারটার দিকে হঠাৎ শুনি দরজার ধুম ধুম শব্দ। আমি আর শৈশব দুজনেই বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। এত রাতে কে আসতে পারে?

দরজা খুলে দেখি পুরো দরজা জুড়ে বিশাল জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আনা। মুখে একান ওকান জোড়া হাসি। হাতে কেক। আমাকে দেখামাত্রই সে সারপ্রাইজ বনিতা! বলে গগনভেদী চিৎকার দিল। আমি হকচকিয়ে ভালো করে আবার তাকাতেই দেখলাম পেছনে আছে আমার এক ভারতীয় বান্ধবী এবং নেপালি বন্ধু। সে সবাইকে নিয়ে মধ্যরাতে আমার বাসায় এসে হাজির হয়েছে। সাথে বিখ্যাত মেক্সিকান ‘ট্রেস লেচেস কেক’। টেবিলে কেক রেখে ঢাকনা খুলেই হতভম্ভ হতে হল! কেকের উপর একদম পাড়ার দেয়ালে বাংলা সিনেমার পোস্টার আঁটার মত আমার আর শৈশবের বিয়ের দিনের ছবি প্রিন্ট করা। আর তাতে বাংলায় লেখা,

‘শুভ বিবাহ বার্ষিকী’

জয়তু গুগল ট্রান্সলেটর! জয়তু আনা!

কেন যেন কেকের দিকে তাকিয়ে আমি সেদিন প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলাম। চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিল। আমি সব সময়ই বলি আমার বন্ধুভাগ্য ভালো। জীবনের বিভিন্ন সময়ে, নানা দুঃখের মাঝে আমার বন্ধুরা আমার বেঁচে থাকার আনন্দ তীব্র করেছে। দুঃখ মুছে দিয়েছে। তবে দূর প্রবাসে এসে এখানেও যে এমন কিছু মানুষ পেয়ে যাব তা আসলে মুখে স্বীকার করলেও মনে মনে কখনও ভাবি নি। কেক হাতে নিয়ে আমি বিশালদেহী মেয়েটার দিকে তাকালাম, সে তার ফোলা গাল আরও ফুলিয়ে ঠোঁট গোল করে বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি বনিতা।

আমি নিশ্চিত এই লেখা পড়ে আজকের পর যে কেউ আনাকে দেখা মাত্রই তাকে চিনে ফেলতে পারবে। তাই পাঠক, যদি তাকে চিনতে পেরে আপনি হাই, হ্যালো, ওলা না বলে ভুল করে হলেও সালাম দিয়ে বসেন তাহলে কী হবে ভাবুন তো?

আমিই জানিয়ে দিচ্ছি, আনা এক নিমিষে উত্তর দিবে, ওয়ালাইকুমুসসালাম।

অজস্র বাংলা শব্দ, বাক্য, গানের কলি তাকে ব্যক্তিগতভাবে আমি শিখালেও সালামের উত্তর দেওয়া সে একটি ইরানি সিনেমা দেখে নিজেই শিখেছে। আমি নিশ্চিত এই মেয়েটি যদি পড়ালেখা মাঝপথে ছেড়ে না দিত তাহলে সে জীবনে অনেক দূর আগাতে পারত।

কিছুদিন আগে ফেসবুকে আনার পাশে আমার ছবি দেখে আমার এক বন্ধু মন্তব্য করেছিল, একি! এ দেখি হিমালয়? সেই মন্তব্য আমি দেখার আগেই ও আমাকে ম্যাসেজ জিজ্ঞেস করল, তোমার ফেসবুক ফ্রেন্ড আমাদের ছবিতে নেপালের পাহাড়ের নাম লিখেছে কেন?

আমি উভয়দিকের বন্ধুত্ব এবং পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বললাম, আমার বন্ধু বোঝাতে চেয়েছে তোমার এবং আমার বন্ধুত্ব পৃথিবীর সর্বোচ্চ পাহাড় হিমালয়ের মতই মজবুত এবং উচ্চ। আর হিমালয় ছাড়া যেমন নেপাল কিছুই না, এই প্রবাসে তোমার বন্ধুত্ব ছাড়াও আমি কিছুই না। এটাই বোঝাতে চেয়েছে সে।

আনা আমাকে এরপরের রবিবার চার্চ থেকে ফিরে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিল,

বনিতা,

সৃষ্টিকর্তা আমাদের বন্ধুত্ব অটুট রাখুক।

ইতি

হিমালয়

আমি হাসি চাপতে চাপতে সেই ম্যাসেজের উত্তর লিখেছিলাম। আমি জানি ওর নাছোড়বান্দা স্বভাবের জন্য আমি মাঝে মাঝে যতই বিরক্ত হই না কেন এই বিদেশ ভুঁইয়ে ‘আনা’ নামের চরিত্রটি আমার জীবনে নানা সুখস্মৃতির জন্ম দিয়েছে। তা না হলে সোশ্যাল নেটওয়ার্কের এই ব্যস্ত জীবনে ক’জন মানুষ আছে যে কিনা আমাকে ট্রাকে তুলে সিয়াটল চলে যাওয়া স্বপ্ন দেখে? কিংবা বছরখানেকের পরিচয়ে আমার সাথে বাংলাদেশ ঘুরে আসার ইচ্ছে পোষণ করে? কয়জনই বা আছে মাসে একটা দিন হলেও ভালোবাসায় চ্যাপ্টা করে ফেলার মত ম্যাসেজ দিয়ে জিজ্ঞেস করবে,

‘বনিতা’
-হ্যাঁ বলো।
– আজকে রাতে কি আমি একটা নতুন রান্না করতে তোমার বাসায় আসতে পারি? এবারের রেসিপি ক্যারামেল সিনামন অ্যাপেল ইনচিলাদাস।

যদিও সেই মুহূর্তের জন্য সমস্ত সুখস্মৃতি ভুলে গিয়ে আমি মনে মনে বলব ‘মারছে আমারে’!

দেসপেদিদা

উইচিতা, ক্যানসাস।