বধির যে ভাষা বোধের দিকে (পর্ব-২) নাহিদ ধ্রুব

নদী মরে যাচ্ছে ,নদীটির তীর ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটি চপলা বট বৃক্ষ। নদীর পানিতে তার ছায়া পড়ে, নদীটি মরে যায় এবং পানিতে ছায়ার সমাপ্তি ঘটে। যদিও মৃত্যু ভয়ংকর কিন্তু এই সমাপ্তিতে কী আপেক্ষিক কোন আনন্দ আছে? এই আনন্দের অনুসন্ধানে আমাদের বারবার ফিরে আসতে হয় বোধের কাছে। এই বোধকে একটি নৈবেদ্য ঝংকারের এক মোহাবিষ্ট কারাগার বলা চলে। যার থেকে হয়তো জন্ম নেয় শিল্প। এই প্রসঙ্গে মনে পড়লো সেদিন দেখা একটা জার্মান সিনেমার কথা, “LIVES OF OTHERS’’। সিনেমাটিতে একজন লেখক একজন নিঃসঙ্গ মানুষ কে প্রভাবিত করে, তাকে একটি অন্য জীবনের ইংগিত দেন সেটা শুধু লেখা দিয়ে নয়, লেখকের চিন্তা- চেতনা এবং জীবনযাপন দিয়ে অবশ্যই। লেখকরা সব সময় একটা DELUSION এর জগতে বাস করে আর তার প্রতিফলন পাওয়া যায় তার রচনায় তার শিল্পে, যে শিল্প আদতে আমাদের নিয়ে যায় এক অমীমাংসিত বোধের দিকে। আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, ‘বাস্তব জগতের পুরোটাই মায়া একটাই সমস্যা মায়া ধরার কোন পথ নেই’। কবিতায় কিংবা শিল্পে আমরা হয়তো এই মায়া ধরার চেষ্টাই করি।

উপরের সমস্ত বয়ান যে কারনে দেয়া হলো তার সাথে সামগ্রিক আলোচনার হয়তো কিছুটা মিল আছে কিংবা নেই, তবে যে বিষয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি তাকে যদি Cause and effect দিয়ে বিশ্লেষণ করতে চাই তবে প্রাথমিক অবস্থায় অবশ্যই আমাদের মায়াজগৎ কে প্রতিষ্ঠিত করেই আগাতে হবে। যেহেতু, ধারণা করছি বিপন্ন কোন বোধ থেকেই শিল্পের জন্ম, কবিতার সৃষ্টি, সেহেতু সে পথ অবলম্বন করতে গিয়ে সহজাত একটা পৃথিবীর বাইরের কোন জগৎ কে কল্পনা করা যেতে পারে। কিন্তু, সে জাদুবাস্তব সময়ের কথা বলার জন্য আমাদের প্রয়োজন ভাষা এবং প্রকাশভঙ্গীর। আর ঠিক এই জায়গাটাতে দাঁড়িয়েই খুব সহজে একজন লেখক কিংবা কবি অন্য আরেকজনের থেকে সরে যায় যোজন যোজন দূরে। কহলীল জিবরানের একটি বিখ্যাত উক্তি’র কথা মনে পড়ছে প্রসঙ্গ ক্রমে , “Trees are poems the earth writes upon the sky, We fell them down and turn them into paper,That we may record our emptiness.”

আমাদের এই শূন্যতা থেকে যে প্রকাশের শুরু তা একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম। ফটোগ্রাফি নিয়ে একটা গল্প এমন প্রচলিত আছে, পৃথিবীর সেরা ৫ জন ফটোগ্রাফারকে একটি কামরায় নিয়ে আসা হলো এবং তাদের কে একটি নির্দিষ্ট সাবজেক্ট, নির্দিষ্ট সেট এবং একই প্রফে ৫ টি আলাদা ছবি তুলতে বলা হলো এবং একজন আরেকজনের উপস্থিতির কথাটা একদম জানতো না। তো তারা নিজেদের প্রাপ্ত বিষয়ে ছবি তুলে নিয়ে এলো এবং এক সময় ছবিগুলো পাশাপাশি রেখে দেখা গেলো একই ছবি কিন্তু আলাদাভাবে পাঁচ রকমের অনুভূতি প্রকাশ করছে। এখানেই হয়তো শিল্পের সফলতা এবং সার্থকতা। কবিদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা হয়তো অনেকটা এমন , আমরা একই ভাষায় লিখছি কিন্তু বোধের জায়গাটা ভিন্ন। এই ভিন্নতা এনে দেয় আমাদের প্রকাশভঙ্গী এবং নিজস্ব ভাষা।

কবিতার সমস্ত টুলস , সিনট্যাক্স কিংবা ইমেজ একটি কবিতার গতিবিধি ততক্ষণ নির্ধারণ করতে পারে না যতক্ষণ না কবিতার ভাষায় স্বকীয়তা থাকে। জীবনানন্দকে উদাহরণ হিসেবে টানা যেতে পারে, জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ প্রকাশের নয় বছর পর প্রকাশিত হয় ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ যেখানে আমরা প্রকৃত জীবনানন্দকে খুঁজে পাই। তার ভাষার স্মুথনেস এবং ডেলিভারি তার কবিতাকে অন্য সকলের থেকে খুব সহজেই আলাদা করে দেয় এবং যার দরুন জীবনানন্দ এখনও সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক এবং তার কবিতা এখনও তরুণ কবিদের প্রভাবিত করে। এই প্রভাবিত করে ফেলাটাই কি একজন কবির সবচেয়ে বড় সফলতা নয়?

লেখালিখির শুরুতে আমরা সকলেই প্রভাবের মধ্য দিয়েই যাই। এবং আমি বিশ্বাস করি, বড় কবিদের মধ্যেই প্রভাবিত হওয়ার ক্ষমতা আছে। একজন কবির মধ্যে চুম্বকধর্ম থাকা খুব জরুরী। বিনয় মজুমদার জীবনানন্দ দ্বারা প্রভাবিত হয়েও তিনি শেষ অব্দি বিনয় মজুমদার হয়েছেন কারন, তিনি প্রভাবের বাইরে খুঁজে পেয়েছিলেন নিজস্ব স্বর। পরবর্তীতে বিনয় মজুমদার দ্বারাও অনেকেই প্রভাবিত হয়েছেন। অর্থাৎ, প্রভাবিত হয়ে প্রভাবকে গিলে ফেলাতেই প্রকৃত কবির সার্থকতা।

ভাষার বিন্যাসে অবশ্যই কবির স্বকীয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। কোন বড় কবির অপরিচিত কোন কবিতা পড়লে সচেতন পাঠক খুব সহজেই কবিকে চিহ্নিত করতে পারেন এর পিছনে অবশ্যই ভাষার ব্যবহার উপর্যুপরি ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ, আমার বক্তব্যকে আমি কীভাবে পাঠকের সামনে উপস্থিত করবো তার একটি ডায়াফ্রেম কবিকেই সন্ধান করে বের করতে হয়। দুটো কাছাকাছি কবিতাকে উদাহরণ হিসেবে দেয়া যেতে পারে,

‘আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
 আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
 পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
 জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
 অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
 আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
 হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
 নক্ষত্রের নিচে’

--- জীবনানন্দ দাশ
‘মনে মনে বহুদূর চলে গেছি – যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়
 জন্মেই হাঁটতে হয়
 হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে
 একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি
 পথ তো একটা নয় –
 তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা
 নদীর দু – প্রান্তের মূল
 একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূণ্য
 দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোরেন –দুটো জন্মই লাগে
 মনে মনে দুটো জন্মই লাগে’

--- শক্তি চট্টোপাধ্যায়

দুটো কবিতার বক্তব্য খুব কাছাকাছি হলেও কবিতার প্রকাশভঙ্গী দুইজন কবিকে আলাদা করে দিয়েছে খুব সহজেই। আবার ,সুনীলের ‘আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি নিখিলেশ’ কবিতার সাথে ভাস্করের ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’ কবিতার টোন অনেকটা কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও সেন্টেন্স মেকিং এবং ডেলিভারী দুটো কবিতাকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং সমান জনপ্রিয় করেছে।

আরেকটা উদাহরণ দিয়ে বক্তব্যকে আরও সহজ করার চেষ্টা করছি ,

‘চলে গেলে- তবু কিছু থাকবে আমার : আমি রেখে যাবো
আমার একলা ছায়া, হারানো চিবুক, চোখ, আমার নিয়তি’

--আবুল হাসান
‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না-থাকা জুড়ে’

--রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

এখানেও দুটো কবিতার বক্তব্য কাছাকাছি হলেও প্রকাশভঙ্গী সম্পূর্ণ আলাদা হওয়ায় কবিতা দুটো খুব সহজেই দুটো আলাদা পথ করে নিয়েছে। এটাই হয়তো সার্থক কবিতার বাস্তবতা।

পৃথিবীতে আজ অব্দি অসংখ্য কবিতা লেখা হয়েছে, পৃথিবীতে আগামীতেও লেখা হবে অসংখ্য কবিতা। এইসব কবিতার মধ্যে চিরস্থায়ী বলতে কিছু নেই তবুও কিছু কবিতা যুগের পর যুগ বাঁচে তাদের ভাষা এবং প্রকাশভঙ্গী তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে। অর্থাৎ একজন প্রকৃত কবিকে অবশ্যই এমন কিছু করতে হবে এমন এক ভাষায় সন্ধানে যেতে হবে যেন পাঠক সে কবিকেই পড়তে পারে, তার ভেতর অন্য কোন কবিকে নয়।

মানুষ আঁকতে গেলে একটা মাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যদি আপনি সে কৌশল রপ্ত করতে পারেন তাহলে আপনি খুব সহজেই একটা মানুষের পোট্রেট করতে পারবেন কিন্তু চাইলেই মোনালিসা আঁকতে পারবেন না। মোনালিসার বিশেষত্ব হচ্ছে তার অবয়বে ভ্রু অনুপস্থিত তাই আমরা চাইলেও কিছুতেই তার বডি ল্যাংগুয়েজের সাথে আবেগ, অনুভূতির সাথে কমিউনিকেট করতে পারি না আমরা সহজে চলে যাই এক ঘোরের জগতে, এমন এক জগতের সন্ধান দিতে পারে কবিতা। তাই বিক্ষিপ্ত বধির ভাষাকে কেন্দ্রীভূত করে যদি নিজস্ব বোধের জন্ম দেয়া যায় তাই হয়তো প্রকৃত কবিতা হয়ে উঠবে।

কবি অসম্পূর্ণ কিছু হতে পারে না। তাইতো বারবার জীবনানন্দের কবিতার কথায় ফিরে যেতে হয়,

‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি। কবি-কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণতাদের সাহায্য করেছে।সাহায্য কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতর অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্য প্রাপ্ত হয়। ’

তাই বিশ্বাস করি , দুকলম লিখলে হয়তো কবি হওয়া যায় (!), কিন্তু আদতেই কী কবি হওয়া যায়?