বঙ্গদেশী মাইথোলজি রাজাধিরাজ দক্ষিণরায় – রাজীব চৌধুরী

১.

রতাই বাউল্যা নৌকা চালিয়ে ভোরে বনের ভেতর প্রবেশ করেছে।

গভীর ঘন বন।

দুধারে বিশাল বিশাল সব সুন্দরী গাছ।

এর মাঝে নদীর একটা শাখা। সেই শাখায় বিশাল নৌকা নিয়ে সবে প্রবেশ করেছে রতাই। সাথে তার ছয় ভাই। নিতাই, গদাই, কানাই, লালু, নিমাই ও কালু। রতাই এর ছোট্ট ছেলে মনাই ও আছে সাথে।

রতাই নতুন ব্যবসা পেয়েছে। এক বণিক ওকে বাণিজ্য তরী বানানোর কাজ দিয়েছে। এজন্যে বনে এসেছে গাছ কাটার জন্যে। বনের ধারে নৌকা থামিয়ে ছোট বড় নানান গাছ কাটতে শুরু করেছে সবাই মিলে। দেখতে দেখতে সাতটি নৌকা বোঝাই হল কাঠের গুঁড়িতে। এবার ফেরার পালা।

এসময় নিতাই প্রথম দেখল ওটা।

বিশাল একটা গাছ। এতো বড়ো গাছ জীবনে দেখেনি ওরা।

নিতাই বলল- “দাদা-চলো এই গাছটাও কেটে নিয়ে যাই…”।

লোভে চিকচিক করে উঠল রতাই এর চোখ দুটো। এই বিশাল গাছ দিয়েই তো দুটো বজরা হয়ে যাবে। বড় একটা জাহাজই তো হয়ে যাবে।

অমনি সাত ভাই মিলে কাটতে শুরু করে দিলো সেই গাছ… কিন্তু ওরা খেয়াল করেনি… ওদের দিকে এগোতে শুরু করেছে কারা যেন।

প্রথম গদাই টের পেল ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে যাবার আগেই ওর মাথাটা ডিমের খোসার মতো কুড়কুড় করে ভেঙে গেল। লালু আর কালু টের ই পায়নি কিছু। এর আগেই মৃত্যু বরণ করেছে।  নিমাই আর কানাই এর পরেই লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।

রতাই বিশাল কুঠার দিয়ে সেই বৃক্ষের গোড়ায় কুপিয়ে চলেছে। রতাই এর ছেলে মনাই মন দিয়ে কাঠ জোগাড় করে নৌকায় তুলছে… দুজনের কেউ অনেকক্ষণ বাকিদের সাড়াশব্দ না পেয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো আশেপাশে… তখন দেখতে পেল নিতাই এর কুঠার পড়ে আছে মাটিতে। খানিক দূরেই ছ’ভাই এর লাশ স্তুপিকৃত। অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে বিশালাকার ছ’টা বাঘ। সবার মুখে রক্ত। থাবায় লাল রক্তের ছাপ। অমনি মাটিতে আছড়ে পড়লো রতাই… এ দৃশ্য দেখতে হবে ভাবতেও পারেনি সে।

গড় গড় শব্দ বেরুচ্ছে বাঘেদের মুখ থেকে। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে একটা বাঘ বিশাল এক গর্জন ছাড়লো… রতাই এর বুকের ভেতরটা অমনি খালি হয়ে গেল নিমেষে। পিপাসা পেয়েছে। কিন্তু এখন পানি চাওয়ার বা দেয়ার মত বেঁচে নেই কেউ। সবাই মরে পড়ে আছে এদিক-সেদিক। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পুরো গাছের গোড়া।

–   বাপধন…মনাই…তোর মার কাছোত ফিরি যা। আমি আর এই মুখ হামার মার কাছত দেখাত পারবিনি। আমি ইখানেই মরমু। এই বাঘের লগে যুদ্ধ করি মরমু। তুই যা- পালায় যা। নিজের মা’র কাছত ফিরি যা। বংশ রক্ষা কর। মা জিগাইলে কইস তোর বাপে বাঘের পেটে গেছে…

ছেলেকে বাঁচাতে হবে। এই এতগুলো বাঘের সাথে যুদ্ধ করে সে পারবেনা। কিন্তু ওকে পারতে হবে। বংশের প্রদীপ নিভে যাবে নইলে। নিজের ও বেঁচে থাকা একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর চিন্তায় অস্থির রতাই টের পেল শব্দ আসছে দূর থেকে। কে যেন বাজখাই গলায় কথা বলে উঠল…

‘রতাই-তোরা আমার বাসস্থানের ক্ষতি করছোস। এজন্যে তোর ছয় ভাইরে আমি আমার পোষা বাঘেগো খাওয়াইসি”।

‘ কেডা? কেডা গো আফনি? আফনের কী খতি করিছি আমরায়? আমার বাইয়েগো এমুন মরণ আমি দেখতাম! এই আছেল আমার কপালোত…”

‘ আমি দক্ষিণরায়…তোরা আমার বাসা কাটছোস। আমার ঘুমের যায়গা নষ্ট করছোস… এর লাইগ্যা আমি তোগোর সক্কেলেরে খুন করাইসি… তোর বাচ্চারে আমার নামে বলি দে। নইলে তোর ছয় ভাই বাইচা উঠতো না”।

“ওহ দক্ষিণঠাকুর-তোমার দুইটা পায়ে পড়ি- তুমি ইঠা কি শোনালি আমায়। আমি কী করি আমার ছাওয়ালের গলাত ছুরি চালামো? হামার ছাও দুধের শিশু… তুমি কেমন ঠাকুর গো?”

“তাড়া দে। দেরী করিস নে। হামাক খিদা লাগিছে…”

“ তুমি এটুক বুঝ গো দেও। হে দক্ষিণরায়…”

“ ছাও গেলে ছাও পাবি- ভাই গেলে নিজেও মরবি- ভাই তো নাই- ছাও ও মরবো…”

নিজের এতটুকু ছেলের মুখে দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলল রতাই। কত কষ্ট- কত দিন রাত শ্রমে এই শিশুকে বড় করে তুলেছে রতাই… সেই ছেলেকে আজকে জবাই করতে হবে দক্ষিণরায়ের উদ্দেশ্যে… ঘোরের ভেতর চলে গেল রতাই। ছেলেটাও বোধকরি বুঝতে পারলো নিজের বাবার মনের ভেতরকার যুদ্ধ… ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বাবার কাছে। ওর বাবার হাতে ধরা একটা ছুরি। ধারালো ফলাটা নিমেষে নেমে গেল গলার এধার ওধার। মুহুর্তে গলুইয়ের ওপর গড়িয়ে পড়লো মনাই এর আটবছর বয়েসী মাথাটা… ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে বাঘগুলো… একটা বাঘ তো কেঁদে ই ফেলল এটা দেখে। হুংকার ছাড়লো সব কটা বাঘ মিলে… সেই কান্নাজড়িত হুংকারে কেঁপে উঠল বিশালাকার সেই বন।

ধীরে ধীরে বইতে শুরু করেছে নদী… যেন এতোক্ষণ থেমেই ছিলো… বইতে শুরু করেছে মৃদুমন্দ বাতাস। প্রায় নিশ্চল রতাই এর কানে তেমন কোন শব্দই ঢুকছেনা। সে তাকিয়ে আছে নিজের সন্তানের কাটা মাথাটার দিকে…

ঠিক এসময় সেই বিশালাকার গাছ থেকে নেমে এলেন এক ফর্সা অবয়ব। মাথায় মুকুট। হাতে তীর ধনুক। কোমরে তলোয়ার। পরনে রাজার পোশাক। শরীর থেকে বেরুচ্ছে আলোকচ্ছটা। সেই আলোয় চারপাশ আলোকিত হয়ে গেল। ছ’টা বাঘ প্রায় ছিটকেই সরে গেল হাত দশেক দূরে। সেই আলো থেকে বাঁচতে মুখ ঢাকলো রতাই।

এর ঠিক পরেই দেখল ওর হাতের ছুরিটার ফলা রক্তাক্ত থেকে হঠাৎই আগের মতো হয়ে গেছে। ওকে জড়িয়ে ধরলো সদ্য জীবিত হওয়া ছেলে মনা। ছেলেকে ফিরে পেয়ে জড়িয়ে ধরলো রতাই… এঁকে এঁকে জীবিত হল ওর ছয় ভাই… সবাই মিলে দক্ষিণরায়কে প্রণাম জানিয়ে ফিরে গেল নিজেদের ডেরায়। যাওয়ার আগে সেই বৃক্ষের পাশেই একটা ঘর বানিয়ে দিলো ছন দিয়ে। সেই ছনের ঘরের চিহ্ন দেখে যেন সবাই দক্ষিণরায়কে চিনতে পারে… এরপর যাত্রা করলো রতাই…

২.

-কী হে রতাই… এটা তুমি কী বানালে হে? এই জাহাজ মোটেই ত আমার পছন্দ হয়নি…

কথা বলে উঠলেন পুষ্প দত্ত।

তিনি বিশাল ব্যবসায়ীর পুত্র। প্রতিবছর সাগর পাড়ি দিয়ে দূর দেশে যাবেন বলে মনস্থির করেন। দূরদেশ থেকে লবঙ্গ নিয়ে ব্যবসা করবেন বলে ঠিক করেন। নিজের হারানো পিতার খোঁজ করবেন বলে ঠিক করেন। অথচ পারেন না। এজন্যে এবার আটঘাট বেঁধেই নেমেছেন তিনি। রতাইকে ফরমায়েশ দিয়ে বানিয়েছেন বিশাল এই জাহাজ। কিন্তু দেখতে একদমই বাজে জাহাজটা দেখে মুখে বিরক্তি ও ক্রোধ ফুটে উঠল পুষ্প দত্তের।

-সব দক্ষিণরায়ের কৃপা বাবু… উত্তর দিলো রতাই।

– দক্ষিণরায়? কে সে?

– ওভাবে কতি নেই হুজুর। তিনি বনের রাজা। তিনি জগধীশ্বর।

– জগদীশ্বর? কে উনি? নাম তো শুনিনি আগে… উনি কি তোমার নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন নাকি নদীতে?

-আমিও জানতুম না বাবু…

– তা কীভাবে জানলি?

– উনি আমার ছেলেকে নতুন জীবন দিয়েছেন বাবু। আমার ভাইয়েরা সব বাঘের পেটে গিয়েছিলো। তিনিই আবার জীবন দেছেন।

– বলো কী!

শুনতে শুরু করলেন সব ঘটনা। কিন্তু পুষ্প দত্তের মন পড়ে আছে সমুদ্রের ওপারে। এজন্যে নতুন করে মিস্ত্রীর খোঁজ শুরু করলেন। দিকে দিকে ছড়িয়ে দিলেন সে কথা। পুরষ্কার হিসেবে এক বাক্সো স্বর্ণ দেবেন বলে ঘোষণা করলেন। সেই ঘোষণা দেয়ার একদিন পরেই নৌকা তৈরি হয়ে গেল চোখের নিমেষে। পুষ্প দত্ত রাজার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে চড়ে বসলেন সেই অনিন্দ্য সুন্দর বজরায়। ওটার নাম দেয়া হল মধুকর। কিন্তু তিনি জানলেন না এই নৌকা বানিয়ে দিয়েছে দুজন কারিগর। তাঁদের একজন হনুমান-আরেকজন বিশ্বকর্মা। দেবাদিদেব মহাদেব স্বয়ং আদেশ দিয়েছে দু’জনকে। এজন্যেই ওনারা এসেছিলেন। ক্ষুদ্র সময়ের মাঝে ছ’টুকরা কাঠ থেকে বানিয়ে ফেলেছেন বিশাল ও সুন্দর একটা বজরা। পুষ্প দত্ত অবশ্য এটাও জানেন না সামনে কী ঘটতে চলেছে… সে শুধু সময়ের সাওয়ার…

৩.

সুশিলা বসে আছেন সোনার পালংকে…

কাঁদছেন।

নিজের সন্তানকে হারানোর ভয়ে কাঁদছেন।

কাঁদছেন আর সামনে সুন্দর দেব মুর্তির দিকে হাত জোর করে বসে আছেন। তিনি টের পাননি অন্য কেউ এসে দাঁড়িয়েছে ওনার পেছনে। তিনি নিজের সন্তানের চিন্তায় বিভোর। কী হবে সন্তানের? পুষ্প দত্ত ওনার একমাত্র সন্তান। স্বামী দূর দেশে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ব্যবসা করতে গিয়ে আর ফেরত আসেননি। ছেলেও যদি ফেরত না আসে… মায়ের মন… কাঁদছেন তিনি একারণেই…

হঠাৎ পেছনে কথা বলে উঠল সুন্দর অথচ কঠোর একটা কন্ঠস্বর…

–   কী ঘটেছে সুশিলা? কাঁদছ কেন?

–   কে? কে আপনি?

–   আমি দক্ষিণরায়। তুমি যার কাছে হাতজোড় করে মিনতি করে চলেছো- সেইই আমি।

–   হে দেবতাদের রাজা তুমি আমার সন্তানকে রক্ষা করো…

–   তোমার সন্তান সুস্থ থাকবে। ভালো থাকবে। আশির্বাদ করলাম।

–   কোন বিপদ হলে রক্ষা করবে তো?

–   অবশ্যই। এই প্রসাদ তোমার ছেলেকে দিও। বিপদে পড়লেই আমাকে স্মরণ করলেই আমি হাজির হব। এবার আমাকে বিদায় দাও…

অদৃশ্য হলেন দক্ষিণরায়। সুশীলা দেবী চোখের পানি মুখে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। ছেলে পুষ্প দত্তের বজরা ছেড়ে দেয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। দ্রুত ছেড়ে দেবে ওটা। এর আগেই ওনাকে পৌঁছাতে হবে… দক্ষিণরায়ের দেয়া পুজার প্রসাদ নৌকায় পৌঁছাতে হবে। তাহলেই সকল অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষা পাবে পুষ্প দত্ত।

ওদিকে নৌকা প্রায় ছাড়ি ছাড়ি করছে… যে কোন সময় নোঙর তুলে নেবে বজরা। দূরে যেতে হবে ওদের। অনেক দূরে। কারণ পুষ্প দত্ত আদতে জানেই না ওর বাবা ঠিক কোথায় আছে। তাই এই যাত্রাটা যেমন অনিশ্চয়তার তেমনই ভয়াবহ। মনে মনে বুকে ফু দিয়ে এগিয়ে গেল পাটাতনের দিকে। বজরা ছেড়ে দিবে প্রায় এমন সময় পুষ্প দত্ত দেখতে পেল অনেক দূর থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে আসছে ওনার মা। সুশীলা দেবী… অথচ তিনি বিদায় নিয়েই এসেছিলেন মায়ের কাছ থেকে… তবে কী কোন বিপদ হল? বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল পুষ্প দত্তের।

– মা তুমি হঠাৎ এখানে? বজরা তো আরেকটু হলেই ছেড়ে দিতো…

বলে উঠল পুষ্প দত্ত। ওর চোখে মুখে ভয়। কিন্তু মাকে শেষ মুহুর্তে দেখে শান্তি পাচ্ছে অনেক। ইচ্ছে ছিলো মায়ের অলক্ষেই বাবাকে খুঁজতে পাড়ি দেবে সে। কিন্তু পারলো কই।

–   হ্যাঁ বাবা- এই নে-এই প্রসাদটুকু রাখ। দক্ষিণঠাকুরের প্রসাদ। এটা খেয়ে ওনাকে স্মরণ করবি। উনি তোকে রক্ষা করবেন।

–   মা আমার কী এমন হবে যে আমি দেবতার স্মরণ নেব? আমি তো কেবল আমার বাবাকেই খুঁজতে যাচ্ছি।

–   আমি জানিনা বাবা- তোকে প্রসাদ গ্রহণ করতেই হবে। নইলে তোকে আমি ছাড়বো না। তোর বাবাকে হারিয়েছি। তোকে হারাতে চাইনা।

–   ঠিক আছে মা। প্রণাম…

মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিতেই বজরা ছেড়ে দিলো। দূরে মিলিয়ে গেল পুষ্প দত্ত। দূরে মিলিয়ে গেলো ভালোবাসা-আবেগ-মায়া-মমতা। সুশীলাদেবী অনেক আগেই এগুলো একবার ত্যাগ করেছিলেন। আজ আবার করতেই হলো…স্বামীকে ফিরে পাওয়ার অদম্য ইচ্ছায়।

৪.

বজরা এগিয়ে চলেছে।

দুপাশে নগ্ন নদী। নদীর বুকে কলকল ছলছল জল। লক্ষবছর ধরে বয়েই চলেছে। বয়েই চলেছে সহস্র মানুষের হাসি কান্না। স্মৃতি- ইতিহাস। নদীর কিছুই মনে থাকেনা। মানুষ কিছু কিছু মনে রাখে। পুষ্প দত্ত মনে করতে চায় কিছু স্মৃতি। ওর বাবার স্মৃতি। অনেক ছোট্টবেলা বাবা ওকে ভাত খাইয়ে দিতো… খেলতো রাতের বেলা। ঘুমুতে যাওয়ার আগে শুইয়ে শুইয়ে দেবতার গল্প করতো। অনেককাল দেখেনি সে বাবাকে। দেখলে চিনতে পারবে কিনা তারই ঠিক নেই। শুধু জানে সমুদ্র পেরিয়ে গিয়েছিলো তার বাবা। শুধু এটুকু শোনার ওপর ভিত্তি করেই এগিয়ে চলেছে সে সমুদ্রের দিকে। পথে পথে কতো ইতিহাস দেখতে পেল সে। দেখতে পেল দক্ষিণরায়ের মূর্তি। শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করলো দক্ষিণরায়কে। কিন্তু বজরা থামেনা। এগিয়ে চলে। এগিয়ে চলে সময়। দক্ষিণরায়ের মূর্তির খানিক দূরেই দেখতে পেল একটা মাটির ঢিবি। ঢিবির পাশে কজন ফকির বসে আছে। জিকির করছে “আল্লাহু আল্লাহু” রবে। আশেপাশে সেই মোহময়তা ছড়িয়ে পড়েছে। পাশেই দাঁড়িয়ে দেখছিলো সর্দার। তাকেই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলো পুষ্প।

–   আচ্ছা দক্ষিণরায়ের মুর্তির পাশেই এমন মাটির ঢিবি। আবার তার পাশেই এমন জিকির করছে। কেন? কী এটা?

–   এই মাটির ঢিবি তো গাজী খাঁ র। এককালে এখানেই গাজী খাঁর সাথে দক্ষিণরায়ের যুদ্ধ হয়েছিলো।

–   যুদ্ধ? দেবতার সাথে মানুষের?

–   গাজী খাঁ তো পীর ছিলেন। বিশাল পীর। তাঁর নামে বাঘে মোষে একঘাটে জল খেত।

–   কিন্তু দক্ষিণরায়ই তো শুনেছি বাঘের দেবতা।

–   ঠিকই শুনেছেন বাবু। দুজনেই বাঘ সর্দার। একজন দক্ষিণের। একজন পুবের। জয় দক্ষিণরায়ের জয়। জয় গাজী কালুর জয়; বলেই হাত জোর করে প্রনাম করতে লেগে গেল সর্দার।

–   আচ্ছা বলতো ঘটনাটা? কেন দুজনের মুর্তি একসাথে? দুজন তো দুই ধর্মের।

–   হবেনা? দুজনের এমন যুদ্ধ লাগলো যে কেউ কারো কাছেই হার মানেনা। শেষমেষ তাঁদের মাঝে এসে দাঁড়ালেন স্বয়ং ভগবান। অর্ধেক ভগবান-অর্ধেক তাঁর পয়গম্বর। দেখেই দুজনে স্থম্ভিত।

–   তারপর?

–   তারপর আর কী? একজন পেলেন দক্ষিণ অংশের শাসনভার। একজন পুবের। আর দক্ষিণের শাসন পেলেন দক্ষিণরায় ঠাকুর।

–   জ্বী বাবু। এটাই ঘটনা। সবাই এখানে মিলে মিশে থাকে। কে হিন্দু কে মুসলিম কেউ হিসেব কষে না। সবাই মাজারে সিন্নি দেয়। দক্ষিণরায়ের কাছে পশু বলি দেয়। এটাই এখানে নিয়ম…

বজরা ততক্ষণে বেশ দূরে চলে এসেছে। চোখে আড়াল হল দক্ষিণ রায় আর গাজীকালুর মাজার। পাশে রইল কেবল নদীর কলকল ছলছল জল। এই জল বহু বছরের ইতিহাসের সাক্ষী। বয়েই চলেছে সে। শুধুমাত্র সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে।

৫.

গভীর সমুদ্র।

গভীর রাত ও বটে।

মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। এর মাঝেই বজরার খাবার শেষ হবার পথে। এর মাঝে কোন দ্বীপ পড়লো না। কোন গঞ্জ ও চোখে পড়লোনা কারো। যতদূর চোখ যায় শুধু জল আর জল। কোন কূল নাই। কিনার নাই। মাঝিরা একটানা দাঁড় বয়েই চলেছে। কিন্তু কূল কিনারা নেই। প্রায় সকলেই ক্লান্ত। ক্লান্তি যখন একঘেয়ে লাগে তখন জীবনের উদ্দেশ্য বলে কিছু থাকেনা। পুষ্প এখন ক্লান্ত। আকাশে ঝুলে আছে এক খন্ড আধখাওয়া চাঁদ। সেই চাঁদের আলো চুইয়ে চুইয়ে মিশে যাচ্ছে সুদূর জলরাশিতে। সে কেবল সেই জলরাশির দিকেই তাকিয়ে আছে। কিন্তু দেখা যায়না।

কালো… কালো… কালো…

আরে! কী ওটা?

একটা রাজবাড়ি। সুন্দর প্রাসাদ। অপূর্ব সুন্দর। কী সুন্দর আলো জ্বলছে…

এ কী সম্ভব?

–   সুবল ও সুবল… এসে দেখে যা… কীরে সর্দার কই গেলে? দেখে যাও..

সবাইকে ডেকে আনার পর দেখা গেল সেই রাজ প্রাসাদ আর দেখা যাচ্ছেনা। বদলে সেখানে দূরের দ্বীপের আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সেই দ্বীপের দিকেই তখন তরী চালানো শুরু হল। বহুকাল পর ঝিমিয়ে পড়া মাঝিদের দল দাঁড় টানতে শুরু করলো। নতুন ভূমির দিকে গমন। এ যেন সত্যিকারের কূল খুঁজে পাওয়া। সত্যিকারের আনন্দ। সত্যিকারের সুখ। তবুও পুষ্পের মনে শান্তি নেই। ও ওর বাবাকে খুঁজে পাবে তো?

৬.

তুরঙ্গ দ্বীপ।

সুজলা সুফলা ও ধণাঢ্য দ্বীপ। প্রতিটি বাড়ির গায়ে স্বর্ণের প্রলেপ। যেন স্বর্গ। এটাই কী সেই স্বর্গ? ভাবছে পুষ্প। আর হাঁটছে।

ওদের বয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিশাল বাহিনী।

তুরঙ্গের রাজা সুরথ। একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি। পুষ্পের বজরা থামার পর পরই তিনি লোক পাঠিয়ে খোঁজ নিয়েছেন ওদের ব্যাপারে। এরপর সেনা পাঠিয়ে দিয়েছেন। বলে দিয়েছেন যেন বিশেষ শ্রদ্ধার সাথে অতিথীদের প্রাসাদে নিয়ে আসা হয়। বহুকাল দ্বীপে কোন অতিথি আসেনি। অনেক বছর পর এলো। অতিথি সৎকারী হিসেবে রাজা সুরথের বিশেষ সুনাম আছে। তাই নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতেই তিনি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছেন। আর পুষ্প এগিয়ে চলেছে সেই আয়োজনের ফল বিচার করতেই। প্রাসাদের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখে ফুলের মালা হাতে দাড়িয়ে আছেন স্বয়ং রাজা সুরথ।

মুগ্ধ হল পুষ্প।

এমন হবে কখনোই ভাবতে পারেনি সে।

বরণ করে নিলেন রাজা পুরো দলটাকেই। সকলেই রাজার অতিথিশালায় প্রবেশ করতে শুরু করলেন। রাজা সুরথ পুষ্প কে জিজ্ঞেস করলেন-

–   কী হেতু আগমন আমার নগরে?

–   হে রাজন- আমি আমার পিতাকে খুঁজতে এসেছি।

–   বলেন কী? তিনি কোথায়?

–   তিনি অনেককাল আগে ব্যবসার জন্যে বিদেশে এসে হারিয়ে গিয়েছেন। আর ফেরত আসেননি। তাই বাবাকে খুঁজতে এসে পৌছে গেছি আপনার নগরে।

–   আহ- আমার সৌভাগ্য। আপনাদের জন্যে আমাদের নগরে সকল প্রকার সুখ- সৌভাগ্য খুলে দেয়া হল। যতদিন ইচ্ছে থাকবেন। খাবেন। ইচ্ছে হলেই চলে যাবেন। শুধু দূর দেশে গিয়ে আমাদের দ্বীপের সুনাম প্রচারই আমাদের সকলের মূল উদ্দেশ্য।

–   তা অবশ্যই রাজন। শুধু এই দ্বীপ কেন? ফিরে গিয়ে গভীর সমুদ্রের ও অনেক সুনাম করবো আমি।

–   তা কেমন? সমুদ্রে কী আছে দেখার?

–   আছে অনেক কিছুই। এই যেমন যেদিকে চোখ যায় শুধু জল আর জল। এর ভেতর কতো রকমের মাছ ভেসে ওঠে আবার ডুবে যায়। কত সুন্দর প্রকৃতি। রাজপ্রাসাদ-দ্বীপ সবই তো সুন্দর।

–   রাজপ্রাসাদ? হা হা হা হা। কী বলছেন এসব? রাজপ্রাসাদ কোত্থেকে আসবে?

–   আমি তো দেখেছি হে রাজন। আমি নিজের চর্মচক্ষে দেখেছি।

–   যা তা বলবেন না। আপনার মস্তিষ্ক বিকৃত হয়েছে। আপনি একজন উন্মাদের মতো কথা বলছেন… ক্ষেপে গেলেন রাজা সুরথ।

–   না রাজন… আমি মিথ্যে বলছিনা এক দন্ডও। চাইলে আপনাকে আমি সেই প্রাসাদ দেখাতে পারবো।

–   যদি না পারেন?

–   তাহলে আপনার সবকটা নৌকাই আমার। সাথে প্রাণ যাবে। গর্দান যাবে আপনার।

–   ঠিক আছে… হয়ে যাক। আমি ঠিকই দেখেছি সেই প্রাসাদ।

–   ঠিক আছে… যদি সেই প্রাসাদ দেখা যায়- আমার কন্যা তোমার। এই রাজ্য তোমার। এই দ্বীপ তোমার। এইটাই রাজ বাক্য…

এই কে আছিস… এখনি বজরা তৈরি কর। আমরা সমুদ্রে যাব। সমুদ্রের মাঝে প্রাসাদ দেখব। আশ্চর্য প্রাসাদ। যাদুর প্রাসাদ। দেখার জন্যে লোভ সইছেনা আমার…

রাজা সভা ত্যাগ করলেন। একা হয়ে গেল অথিতিরা। সকলেই প্রমাদ গুণতে শুরু করেছে। বিপদ আসন্ন। সেই বিপদটা টের পেতে শুরু করেছে সবাই। শুধু পুষ্প বাদে। সে শান্ত-শিষ্ট। সে আদতে জানে সে একটা প্রাসাদই দেখেছে। সত্যিই দেখেছে।

৭.

বধ্যভুমি।

চারপাশে জড়ো হয়েছে লাখ লাখ মানুষ।

সকলের সামনেই প্রাণ নেয়া হবে পুষ্প দত্তের।

তারপর এঁকে এঁকে পুষ্প রায়ের সকল মাঝি মাল্লা দের।

এটাই এ দেশের নিয়ম।

রাজার কথাই আইন।

পুষ্প দত্তের সাথে রাজা গিয়েছিলেন সমুদ্রে। সেখানে রাজাকে দুই রাত তিন দিন কোণ রকম প্রাসাদ দেখাতে পারেনি পুষ্প দত্ত। ফলাফল সেখানেই বন্দী করা হল পুষ্প কে। দ্বীপে ফেরত নিয়ে এসে ঢোকানো হল কারাগারে। পরদিনই মাথা কাটা হবে-প্রচার করে দেয়া হল রাজ্যজুড়ে। এজন্যে এত লোকের আগমন। অনেকদিন এমন দৃশ্য দেখেনি কেউ। প্রচুর প্রাচুর্য কিন্তু বিনোদনের বেশ অভাব।তাই সবাই এসেছে বিনোদন পাওয়ার আশায়।

পুষ্প দত্তকে খানিক পরেই নিয়ে আসা হল।

কোতয়াল এক বিশাল খড়্গ নিয়ে এগিয়ে গেল পুষ্পের দিকে। পুষ্প তখন মনে মনে দক্ষিণরায়ের স্তব করছে। জীবনে এই প্রথমবার প্রাণভয়ে কাতর পুষ্প। বুঝতেই পারছেনা কী ঘটছে। সে শুধুই দক্ষিণরায়ের স্তবে ব্যস্ত।

ঠিক এসময় এক গর্জন শোনা গেল।

বাঘের গর্জন।

একটা দুটো না- শয়ে শয়ে বাঘ।

বিশাল একটা বাঘের পিঠে বসে আছেন দীব্যজ্যোতিবান একজন। তিনিই দক্ষিণরায়। ভক্তের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে এসেছেন সমুদ্র পাড়ি দিয়ে। ওনার মুখে হাসি। মাথায় রাজমুকুট। হাতে তলোয়ার। পিঠে তীর ধনুক। বসে বসেই মুচকি হেসে চলেছেন। আর বাঘগুলো আক্রমণ শুরু করলো জনতারাশির ওপর।

ততক্ষণে ছত্রভঙ্গ হল লক্ষজনতার ঢলে। যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। সৈন্যরা আক্রমন ঠেকাতে গিয়ে দলে দলে প্রাণ হারাতে শুরু করেছে। বাঘেদের হাতে।

-কে আপনি? আমার এলাকায় বাঘ নিয়ে আক্রমণ করেছেন?

দক্ষিণরায়ের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো রাজা সুরথ। ততক্ষণে বাঘের আক্রমনে পেছাতে শুরু করেছে রাজার দক্ষ সৈন্যবাহিনী।

–   আমি দক্ষিণরায়। দক্ষিণের দেবতা। এখানে আমার পুজো কেউ করেনা। তাতেও দোষ নেই। কিন্তু আমার নির্দোষ প্রজাকে হত্যা করা হবে। এটা আমি সহ্য করবো না।

–   তাই বলে দেবতা হয়ে মানুষের সাথে এরকম অসুরসুলভ ব্যবহার? পারলে আমার সৈন্যবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে আসুন।

–   তবে তাই হোক…

এরপরেই শুরু হল যুদ্ধ। বাঘ ও মানুষে যুদ্ধ। দেবতা ও রাজায় যুদ্ধ। রক্তের বন্যা বয়ে গেল নিমেষে। নানান রকম অস্ত্রের ঝনঝনানিতে মুখরিত হল তুরঙ্গ দ্বীপ। যুদ্ধের ফলাফল কখনোই ভাল হয়না। এই যুদ্ধটাও একই ফলদায়কই হল। বাঘেদের কিছুই হলোনা। একশো বাঘ পুরো একটা দ্বীপ সাবার করে ফেলল। আর দক্ষিণরায়ের তীরের আঘাতে সুরথের মাথা দেহ থেকে আলাদা হয়ে গেল। পরাজিত হল রাজার বাহিনী…জয় হল দক্ষিণরায়ের।

৮.

– আমার স্বামীর কী দোষ ছিলো হে দেবতা? তুমি তাঁকে এভাবে হত্যা করলে?

সুরথ রাজার মৃতদেহের ওপর বসে আছে সুরথ রাজার পাটরানী।

রাণী এখন পাগলীনি প্রায়। রাজার মৃত্যুরপর তিনি দিশেহারা। চুল অবিন্যস্থ। পাগল হয়েই উপস্থিত হয়ে দেখেন ওনার স্বামী রাজা সুরথ পড়ে আছেন মাটিতে। মাথাটা বেশ খানিকটা দূরে। সামনে দাঁড়িয়ে দক্ষিণরায় আর একশো বাঘ। অদুরেই অবাক চোখে পুষ্প দত্ত। আর কেউ বেঁচে নেই। সবাই মারা গেছে। বাঘেরা এখন মৃতদেহ ভোজন করছে সানন্দে।

–   তিনি একজন অহংকারী রাজা। নিজের রাজ্যের দেখভাল না করে তিনি নিরপরাধ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতেন।

–   এজন্যে এভাবে হত্যা করবেন?

–   তিনি যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেছেন। যুদ্ধে মৃত্যু একজন ক্ষত্রিয়ের আজীবনের সাধ থাকে। এই মৃত্যু সর্বশ্রেষ্ঠ।

–   কিন্তু আমি ত বিধবা হলাম। আমার এখন কী হবে? এই রাজ্যের কী হবে?

–   তুমি কি তোমার রাজা ও রাজ্য দুটোই ফেরত চাও?

–   পারবে দিতে? পারবে?

–   অবশ্যই। তবে এই নিরপরাধ ছেলেটির সাথে তোমার একমাত্র কণ্যার বিয়ে দিতে হবে। আর ওকে বুঝিয়ে দিতে হবে এই রাজ্য। ওর বাবাকে ফেরত দিতে হবে নিজের জীবন। ওর নিরপরাধ পিতা বিশবছর ধরে আটক আছে তোমাদের কারাগারে। তাঁকে সহ সব বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে এখনই।

–   সব করা হবে। আগে আমার স্বামীকে জীবিত করুন…

দক্ষিণরায়ের মুখে নিজের পিতার কথা শুনে বাস্তবে ফিরে এলো পুষ্প দত্ত। যেই পিতাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান সে-তিনিই কিনা এতোকাল বন্দী ছিলেন সুরথের কারাগারে? এ কেমন বিচার…

৯.

পুষ্প দত্ত রাজকন্যাকে নিয়ে সবে মাত্র নিজের বজরায় চড়ে বসেছেন। সাথে তার পিতা দেবদত্ত। অনেক বন্দীর মাঝ থেকে পিতাকে খুঁজে পেতে তার বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। তার পিতার আটকের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখলো একই রকমই প্রাসাদ তিনি ও দেখেছিলেন এটা রাজাকে জানানোর পর রাজা সেই প্রাসাদ দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি দেখাতে পারেননি। এরপরেই তাঁকে অন্ধ কালকুঠুরিতে নিক্ষেপ করা হয়। এত বছর পর তিনি নিজের সন্তানকে খুঁজে পেয়ে যারপরনাই খুশি। রাজা সুরথ তাঁদের সবাইকে বিদায় দিলেন। তিনি বেঁচে উঠেছেন দক্ষিণরায়ের কৃপায়। এমনকি সকল মানুষ ও বেঁচে উঠেছে ওনার ইচ্ছেতেই। বাঘেরা এলাকা ছেড়ে অদৃশ্য হয়েছে। দক্ষিণরায় অদৃশ্য হবার আগে সকলের প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছেন। পুষ্প দত্ত রাজ্য পেল। রাজা হল। রাজকন্যা পেল। নিজের পিতাকে ফিরে পেয়ে সুরথকে রাজ্যের দায়িত্ব দিয়ে নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনায় এগিয়ে চলেছে।

বজরা বয়ে চলেছে।

সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নদীর জল নেমে এসেছে সমুদ্রে। সেই জল ও সময় মনে রাখেনা। তবে সুরথের তুরঙ্গ দ্বীপ মনে রেখেছে দক্ষিণরায়কে। এরপর থেকে তিনি পুরো দক্ষিণ ও সমুদ্রের ওপাড়ে সমান পুজিত হতে শুরু করেন। এভাবেই দক্ষিণরায়ের পুজো প্রতিষ্ঠিত হল মানব সমাজে। আজো সুন্দরবনে বাঘের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে দক্ষিণরায়ের নামে কালো ছাগল বলি অথবা ছেড়ে দেয়া হয়। দক্ষিণরায়ের নাম স্মরণ করেই জেলেরা মাছ ধরতে যায়। মধু শিকারে যায়। যেখানেই বাঘ-সেখানেই ত্রাতা দক্ষিণরায়। তিনিই পৌরাণিক দেবতাদের মাঝে ঠাই না পাওয়া সবচে ক্ষমতাবান দেবতা।