চরকায় কাটা জীবন – জাহানারা পারভীন

ইংল্যান্ডে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সব শক্তি, সময় ঢেলে দেন লেখায়। মৌলিক নয়, ফরমায়েশি লেখা। লন্ডনের বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে সাহিত্য সমালোচনা, বই পরিচিতি, প্রবন্ধ। সংসারের খরচ চালাতে বিকল্প পথ নেই আর। দুহাতে লেখালেখির ব্যস্ততায় ভিভিয়েনের সাথে কাটানোর জন্য খুব অল্প সময় বাচে। একসঙ্গে হলেও দুজনের কেউ না কেউ অসুস্থ থাকেন। ১৯১৭ সালের ৮ এপ্রিল শাশুড়ি চার্লট এলিয়টকে ভিভিয়েন জানান, এক সপ্তাহ ধরে মাইগ্রেনের ব্যথা ও সর্দিজ্বরে ভোগা কাহিল দশার কথা। নিজের ও স্ত্রীর অসুস্থতা, আর্থিক অনটন, দিনরাত লেখায় ডুবে থাকা, পত্রিকা অফিসে ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে ওঠেন, মনে হয় জীবন যেন চলছে না আর। কঠিন থেকে কঠিনতম হয়ে উঠছে প্রতিটি দিন। এর আগে এমন পরিস্থিতিতে পরতে হয়নি। চলার জন্য রোজগারও করতে হয়নি। পরিবারই যুগিয়েছে সব খরচ। কিন্তু জীবন এখন বেশ কঠিন। লেখার আয়ে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে ওঠে। মনে হয়, শক্তি কমে যাচ্ছে, চাই কিছুটা অবসর, একটু বিরতি। জীবনের এই ম্যারাথনে ছুটতে নামার পর কবিতা লেখার সময় বা মানসিকতা অবশিষ্ট নেই। অথচ কবি হওয়ার স্বপ্নেই এই বিয়ে, বিদেশের অনিশ্চিত বসতি। স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথকে মজবুত করতেই টিকে থাকার প্রাথমিক চেষ্টা, হাটা এই অমসৃণ পথে।

এলিয়টের জন্য এরকম অভিজ্ঞতা একেরারেই নতুন। নিজ শহরের সবচে গুরুত্বপূর্ণ পরিবারে যার জন্ম যার, যার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সব কিছু করেছেন অভিভাবকরা, উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন অক্সফোর্ডে, খেয়ে পরে বাচার জন্য তার এতটা দুর্ভোগ! তবে এই পথ তার নিজেরই বেছে নেয়া। সবকিছু গুটিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে দেশে ফেরার পথ এখনো খোলা। অসমাপ্ত পিএইচডিও শেষ করা যাবে। কিন্তু অপমৃত্যু ঘটবে স্বপ্নের। তার চেয়ে এই ভাল- শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। লেখার পাশাপাশি চাকরির চেষ্টা চলে। একসময় সুযোগ আসে স্কুলে পড়ানোর। ১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বরে যোগ দেন হাই ওকেম্বে গ্রামার স্কুলে। বেতন বছরে ১৪০ পাউন্ড। এক টার্মের জন্য পড়ান এই স্কুলে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। লন্ডনের বাসা থেকে আসা যাওয়ার অসুবিধা হওয়ায় এখানে পড়ানোর সময় থাকেন হাই ওকেম্বের কনেগ্রা সড়কের সিডনি কটেজে। ৩ মাস পর চাকরি হয় উত্তর লন্ডনের হাইগেট জুনিয়র স্কুলে। এটিও লন্ডনের একটি বেসরকারি স্কুল। এখানে ছাত্রদের পড়ান ইংরেজি, ল্যাটিন ও ফরাসী সাহিত্য; ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক অধ্যায় ও ভিক্টোরিয়ান সাহিত্য। ক্লাস নেন লর্ড টেনিসন, রবার্ট ব্রাউনিং, চার্লস ডিকেন্স, ম্যাথিউ আর্নল্ডসহ ইংরেজি সাহিত্যের লেখকদের ওপর। ১৯১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজ করেন এখানে। বেতন আগের চেয়ে বিশ ডলার বেশী। দিনে ছাত্র পড়ানো, রাত জেগে পরের দিনের বক্তৃতার কপি তৈরীর ব্যস্ততা। সেই সাথে আছে ফরমায়েশি লেখা। অধিক পরিশ্রমে অনভ্যস্ত এলিয়ট ক্লান্ত হয়ে ওঠেন। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবেন। মনে হয় এই পেশা তার জন্য নয়। লিখে বেচে থাকার চেষ্টায় বিসর্জিত হয় মৌলিক লেখালেখি। এসময় লেখা নিয়ে প্রকট হয়েছে দ্বিধা।

নিজের লেখা নিয়ে সব সময় দুটো সন্দেহ কাজ করেছে। প্রথমত, এখনো পর্যন্ত যা কিছু লিখেছি তার কোনো স্থায়ী সাহিত্যিক মূল্য নেই। মহাকালের বিচারে টিকবে না এসব কবিতা। এমন ভাবনার ফলে পরের কাজটা করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় সন্দেহটা আরো ক্ষতিকর। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার লেখা কিছু কবিতা খুবই ভাল। আবার এও ভাবি কখনো ভাল কিছু লিখতে পারব না। কেউ যেন সবসময় কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে- আমি যে সংগ্রাম করছি তা ভাল কোনো লেখার দিকে নিয়ে যাবে;কিংবা শেষ করে দেবে আমাকে। যেন আমি শোচনীয় পরাজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, যা আমার ধারনার বাইরে। কবিতা নিয়ে লেখকের অন্তর্গত অনুভূতি কিংবা মানুষের স্বীকৃতি কোনাটাই সন্তোষজনক নিশ্চয়তা নয়। অনেকেই নিজের কবিতার বিষয়ে উৎসাহী অথচ তাদের মতের সাথে একমত নয় অন্যরা। তাদের কেউ কেউ মহৎ কবি হিসেবে উপাধি পায় বিশেষ করে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। জীবনে অন্তত তিনবার,  কিছু সময়ের জন্য হলেও বিশ্বাস করেছি পাঠযোগ্য কোনো কিছু আর লিখতে পারব না। হয়ত এবার সত্য হবে এই আশংকা ।

১৯১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ভাই হেনরিকে জানান, শুধুমাত্র পেটের দায়ে করা শিক্ষকতাকে উপভোগ করছেন না। এ বছরের শেষে ছেড়ে দেবেন চাকরিটা। বলেন লেখালেখির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের কথা-

মনে হচ্ছে কবিতা লেখার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আর কখনোই ভাল কিছু লিখতে পারব না। আমার মনে হয়, প্রুফ্রক কোনো কবিতা নয়,  রাজহাঁসের গান। কিন্তু কখনো এটা নিয়ে কাউকে কিছু বলিনি।

লেখালেখি নিয়ে এই উদ্বেগ, কবিতার খরা আজীবন সঙ্গী ছিল এলিয়টের। তবে প্রথম জীবনে অর্থনৈতিক সংকট ও মানসিক অস্থিরতায়, ও স্কুলে পড়ানোর সময় ভাটা পড়েছে আত্মবিশ্বাসে। এর প্রভাব পড়েছে শিক্ষকতায়। রাসেল মারফি তার টি এস এলিয়ট:  লিটারারি রেফারেন্স টু হিজ লাইফ এন্ড ওয়ার্ক গ্রন্থে এলিয়টের শিক্ষকতা ছাড়ার কারণ সম্পর্কে বলেছেন-

পাউন্ডের সাথে পরিচয়ের পর থেকে সাহিত্য নির্ভর ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছেন। একাডেমিক কেরিয়ারের হাতছানি পেছনে ফেলে আঁকড়ে ধরেছেন কবিতা। অথচ ১৯০৬ সালে হার্ভার্ডে ভর্তির পর থেকে অন্যরকম প্রস্তুতি ছিল। হাইস্কুলে ভাষা ও সাহিত্য পড়ানোর ব্যস্ততা ক্রমশ বেড়েছে। সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে লেখায় মনোযোগ দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এই হতাশা থেকেই ১৯১৬ সালের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় চাকরিটাও ছেড়ে দেন।

চাকরি ছাড়ার কারণ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন এলিয়ট নিজেও..

আমি আসলে কবিতা লিখতেই চেয়েছি। চাকরি শুরু করার আগে ভেবেছি অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে শিক্ষকতায় কম সময় দিলেই চলবে। স্কুলে পড়াতে এসে বুঝেছি কতটা ভুল ছিল এ ধারনা। শ্রেণীকক্ষে ছাত্রদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য পড়ানোর পাশাপাশি নিজের ব্যক্তিত্বকেও তুলে ধরতে হয়। অনেক শিক্ষক এটা বেশ উপভোগ করেন। আমি এটা পারিনি। এই চাকরি আমাকে যা দিয়েছে, নিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশী কিছু।

আপাতত বিরতি শিক্ষকতায়। বেকার মেয়ে জামাইয়ের পাশে দাঁড়ান ভিভিয়েনের বাবা মা। দুজনকে নিয়ে আসেন নিজেদের কাছে। জামাইয়ের জন্য চাকরির চেষ্টাও চলে। ভিভিয়েনের বাবার এক বন্ধু ব্যাংকার। বন্ধুর জামাইয়ের জন্য সুপারিশ করেন লয়েল্ড ব্যাংকে। তদবিরে কাজ হয়। শশুরবাড়ির আনুকূল্যে ১৯১৭ সালের ১৯শে মার্চ  ইংল্যান্ডের লয়েল্ড ব্যংকের বৈদেশিক শাখায় যোগ দেন আমেরিকান নাগরিক এলিয়ট। ব্যাংকিং বদলে দেয় জীবনের বাক, এনে দেয় অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, জীবন ও লেখায় আসে প্রাথমিক ভারসাম্য। কর্মজীবনের দীর্ঘ সময় কাটে এই পেশায়। ১৯২৫ সালে প্রকাশনা সংস্থা ফেবার এন্ড গেয়ারে যোগ দেয়ার আগ পর্যন্ত থেকে যান এখানেই। এই ৯ বছরে লেখা হয়েছে অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। সবচেয়ে আলোচিত কাব্যগ্রন্থ ওয়েস্টল্যান্ড লেখা হয় এখানে কাজ করার সময়। তখন অসুস্থতার সময় ব্যাংক থেকে দীর্ঘদিনের সচেতন ছুটি পাওয়া যায়।  ব্যাংকে যোগ দেয়ার দুদিনের মাথায় মাকে জানান নতুন চাকরির খবর। চিঠিতে প্রকাশিত হয় উচ্ছ্বাস। সবচে অপ্রত্যাশিত চাকরি নিয়ে তার আবেগ। যেন চাকরি নয়, চাঁদ পেয়েছেন হাতে। ছাত্র পড়ানোর পরিশ্রম ও অপ্রতুল বেতনের বিপরীতে এই কাজ তাকে দিয়েছে নিজের সংকল্পের পথে হাটার স্বস্তি। আমেরিকান অধ্যাপক গবেষক, রোনাল্ড বুশ বলেন, বিয়ের পর থেকে জীবিকার ব্যস্ততায় কবিতা থেকে দূরে সরে গেছেন। কবিতায় ফেরার জন্য যে মানসিক স্থিরতা দরকার ছিল ব্যাংকের চাকরিটা তাকে সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।

২১শে মার্চ মাকে লেখেন,

‘এই দুর্দিনে এরকম একটা কাজ পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। অনেকদিন পর মনের মত একটা কাজ পাওয়া গেল। এই কাজ আমাকে মুক্তি দেবে অর্থনৈতিক দু:শ্চিন্তা থেকে। সময় পাওয়া যাবে লেখার জন্যও। এটা আগের চাকরির চেয়ে তুলনামূলকভাবে ভাল। ভিভিয়েনের বাবার এক বন্ধু আমার জন্য সুপারিশ করেছেন। এটি লন্ডনের সবচেয়ে বড় ব্যাংক। আমি এখন সপ্তাহে দুই ডলার দশ সিলিং রোজগার করছি মা। এই বেতন অবশ্যই রাজকীয় নয়। তবে আমার দিব্যি চলে যাবে। এখানে লেগে থাকলে উন্নতি সম্ভব। বৈদেশিক শাখায় এই চাকরিটা পাওয়া গেছে বিদেশী ভাষা জানার যোগ্যতায়। লয়েল্ড কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে আমি বহু ভাষায় অভিজ্ঞ। একটু বাড়িয়েই বলা হয়েছে। অফিস সময় সকাল সোয়া নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা। তুমি জেনে বিস্মিত হবে যে চাকরিটা আমি উপভোগ করছি। ছাত্র পড়ানোর মত এই পেশা ক্লান্তিকর নয়, বরং আনন্দদায়ক। আমার অধীনে কিছু ফাইল কেবিনেট আছে। আমাদের সাথে যেসব বিদেশী  ব্যাংকের লেনদেন আছে সেগুলোর ব্যলেন্সশীট ওখানে রাখা আছে। এসব ফাইল তালিকা অনুযায়ী এমন ভাবে সাজিয়ে রাখি যেন প্রতিটা ব্যাংকের উন্নতি বা অবনতির পরিসংখ্যান এক নজরে দেখা যায়।

যুদ্ধোত্তর লন্ডনের বাস্তবতায় এই চাকরি নিয়ে আপ্লুত হওয়ারই কথা। এমন এক সময়ে এই চাকরি পেয়েছেন, যখন পৃথিবীজুড়ে বিশ্বযুদ্ধের বিপর্যয়। যুদ্ধের কারণে বেকার হয়েছে, যুদ্ধের কুফল ভোগ করছে ইংল্যান্ডের হাজারো মানুষ। বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে অন্য দেশে জীবিকার খোজে নেমেছে বৃটিশ নাগরিকরা। ফ্রান্সে গিয়ে শিক্ষকতা শুরু করেছে অনেকে। লন্ডনের অধিবাসীদের যখন বেচে থাকার জন্য দেশান্তরী হতে হয়েছে, তখন বিদেশী হিসেবে এখানকার প্রতিষ্ঠিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়াটা ভাগ্য বলে মনে হয়েছে। মাকে লেখা চিঠিতে প্রকাশ পেয়েছে আবেগের বাহুল্য। চিঠির মাধ্যমে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, স্বপ্ন নিয়ে সন্দিহান বাবার কাছে বার্তা দিতে চেয়েছেন। সেই শৈশব থেকে যিনি পুত্রের মাঝে কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাননি। এখনো যিনি মনে করেন নষ্ট হয়ে গেছে পুত্রের জীবন। এ ধারনা ভুল প্রমাণ করে নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তুলে ধরতে আগ্রহী পুত্র মাকে বোঝাতে চান, সে এখন আর রুগ্ন বালক নয়, যে শৈশবে ঘোড়ায় চড়ার অনুমতি পায়নি, বঞ্চিত হয়েছে ফুটবল খেলা থেকে, উপহাসের পাত্র হয়েছে সমবয়সীদের।

ইতালী এবং ফরাসী ভাষায় দখল, স্প্যানিশ, সুইডিশ, ডাচ, নওরোজিয়ান ভাষা জানার কারণেই বৈদেশিক শাখার জন্য তাকে উপযুক্ত মনে করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। চাকরির পাশাপাশি পত্রিকায় লেখালেখি অব্যাহত থাকে। মনিষ্ট এবং নিউ স্টেটমেন্ট পত্রিকার সাথে নতুন কিছু লেখা নিয়ে আলোচনা হয়। অফিসের পর সন্ধ্যাটা কিভাবে কাজে আসতে পারে তা নিয়ে ভাবেন। উপার্জনই বড় কথা নয়। লেখার মাধ্যমে নিজেকে পরিচিত করাও জরুরী। নিউ স্টেটমেন্ট পত্রিকায় রিফ্লেকশন অন ভারস বেশ আলোচিত হয়। এই লেখা সাড়া ফেলার পর সম্পাদক ফিলিপ হবি জর্ডিয়ান তাকে অনুরোধ করেন আমেরিকান সাহিত্যের আরো কিছু দিক নিয়ে লিখতে। তাকে পরিচয় করিয়ে দেন সেঞ্চুরি ও ডায়ালের সম্পাদকের সাথে। দুহাতে লিখতে থাকেন ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, ব্রক্ষ্রবিদ্যা, নৃ-ত্ত্ত্ব ও জীববিদ্যা নিয়ে।

এ সময় ভিভিয়ের অসুস্থ হয়ে পড়লে স্ত্রীর স্বাস্থ্য সংকট মোকাবেলা করেন। দায়িত্বশীল স্বামী হয়ে সেবাযত্ন করেন। ভিভিয়েনের স্বরযন্ত্রের ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হতে থাকে। খরচ বাচাতে ভিভেয়েন ছুটা কাজের বুয়া বাদ দিতে চাইলে বাধা দেন এলিয়ট। ঘরের কাজে অসুস্থ স্ত্রীর সব সময় ও শক্তি খরচ হোক মন সায় দেয় না তাতে। উদ্বিগ্ন স্বামীর মনে হয়, সুস্থ না থাকলে গত গ্রীষ্মের মত এবার ভালো ছুটি কাটানো হবে না ভিভের। তার ইচ্ছে জুলাই ও আগস্টে আরেকটি কাজের মেয়েকে নিয়ে ছুটি কাটতে যাক তার স্ত্রী। সম্ভব হলে অল্প সময়ের জন্য হলেও তাদের সাথে যোগ দেবেন তিনি। এলিয়ট লন্ডনে আর ভিভিয়েন গ্রামীণ কোনো পরিবেশে। এক চিঠিতে এলিয়ট বলেন,

এভাবেই খুব সস্তায় বেচে থাকা সম্ভব। প্রতিটি গ্রীষ্মকাল এভাবেই কাটে আমাদের। আমি লন্ডনে আর ভিভিয়েন শহরের বাইরে। কারণ আমার অবর্তমানে লন্ডনের ফ্লাটে ওকে একা রাখতেও অস্বস্তি হয়। বিয়ের পর থেকে এভাবেই কাটছে বেশ কয়েকটি গ্রীষ্মকাল।

১৯১৫ সালের শুরু থেকে এভাবেই চলতে থাকে। বৈশাখে তারা একটা কটেজ ভাড়া নেন। সাসেক্সের উপকূলবর্তী বন্দরে, চিসেস্টারের কাছে। এলিয়টের সব সময় ও শক্তি খরচ হয় টাকার পেছনে ছুটে। এদিকে একের পর এক অসুখের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত  ভিভিয়েন। এই বাস্তবতা দীর্ঘদিন তাদের একসাথে থাকা অসম্ভব করে তোলে। ২৩শে মার্চ চাচাত বোন ইলেনর হিংলিকে এলিয়ট লেখেন,

এমন নয় যে আমি ব্যাংক সম্পর্কে কিছু জানি। কিন্তু ব্যবসাটা এত বড় যে, এই অফিসের মাত্র ছয় সাতজন মানুষকে চিনি। শুধু জানি, তারা কে কোথায় বসেন।

ব্যাংকে তার সহকর্মী মিস্টার মেকনাইট। থাকেন শহরতলীতে। অফিসে শেষে বাড়ির সামনের বাগানে সবজির চাষ করেন। বাড়ি থেকে  বের হলেই পরেন সিল্কের হ্যাট। সুযোগ পেলেই বড় ছেলের কথা বলেন। ১৯৫৪ সালে লেখা দি কনফিডেনশিয়াল ক্লার্ক নাটকের এগারসন চরিত্রটি মেকনাইটকে মাথায় রেখেই লেখা। এছাড়া ১৯১৭ সালে লিখেছেন ছোটগল্প এলড্রপ এবং এপেলেক্স। এখানে এলড্রপ একজন ব্যাংক কেরানী, যে শহরতলীতে থাকে। এপেলেক্স তার রুমমেট। দুজনে যেন এক ধরনের ঘোর আর নির্জনতায় বাস করে।  সমালোচকদের ধারনা এপেলেক্স চরিত্রটি এজরা পাউন্ডকে মাথায় রেখে লেখা। নিজের সৃষ্ট এই দুই চরিত্র সম্পর্কে এলিয়টের মূল্যায়ন-

তাদের দুজনের এমন কিছু রকম মিল আছে যা তাদের পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। দুজনের পেশাগত, দৈনন্দিন এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড আলাদা। দুজনেই ছিল উদ্যমী, শ্রদ্ধেয়, এমনকি সংসারীও। কিন্তু দুজনেই যেন বাস করেন পায়রার খোপে। তারা বড় বেশী নিয়মানুবর্তী। তারা চেয়েছেন মানুষের আত্মাকে এর স্বাতন্ত্র্য দিয়ে উপলব্ধি করতে চেয়েছে তারা।

ভিভিয়েনের দুটো চিঠি থেকে বোঝা যায় নতুন চাকরির সাথে মানিয়ে নিয়েছেন এলিয়ট। ১৯১৭ সালের ৮ এপ্রিল শাশুড়িকে লেখেন,

ব্যাংকের চাকরিতে যোগ দেয়ার পর থেকে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। ওর স্নায়ু এখন আগের চেয়ে ভাল। আগের সেই গম্ভীর বিষণ্ণ, মেজাজ আর নেই। সেই বিরক্তিও নেই চোখেমুখে। লেখালেখিও ভাল চলছে।  সব মিলিয় খুব ভাল বোধ করছে সে। এখন টাকার নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে।

এ মাসের শেষে ৩০ এপ্রিল জানান আরো কিছু তথ্য।

টম ব্যাংকিংকে মনে করছে টাকা রোজগারের পেশা। তার স্বাস্থ্য, চিন্তা সৃষ্টিশীলতায় বড় ধরনের পরিবর্তন ধরা পড়েছে বন্ধুদের চোখেও। ওর মনে হয় বেচে থাকার জন্য এখন আর ফরমায়েশি লেখার ওপর নির্ভর না করে মৌলিক লেখায় মনোযোগ দেয়া সম্ভব হবে।

পাউন্ড আর ভিভিয়েন দুজনেরই দুশ্চিন্তা কেটে যায় যখন দেখা যায় এক সপ্তাহে ৫টি অসাধারণ কবিতা লিখে ফেলেছেন এলিয়ট। সন্দেহ থাকে না যে এই চাকরিটা সাহিত্যবান্ধব। তবে যে চাকরি নিয়ে এত উচ্ছ্বাস, স্বস্তি, সেখানে তার পদ একজন কেরানীর। ৯টা বছর মাথাগুজে কেরানীগিরী করেছেন। ঐতিহাসিক রাসেল কির্ক এলিয়টকে নিয়ে আলোচিত গ্রন্থ এলিয়ট এন্ড হিজ এজ গ্রন্থে ব্যাংকে সেখানে বসে কাজ করতেন কবি সে পরিবেশ সম্পর্কে ধারনা দিয়েছেন।

ওয়েস্টল্যান্ডের প্রকাশনা এবং সাফল্যের পর অনেক কিছু বদলে যায়। আসে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা। তবুও পরিবর্তন আনেননি পেশায়। পূর্ববর্তী লেখকদের মত বিখ্যাত হওয়ার জন্য অনেক পরিশ্রম করেছেন। তবে এই খ্যাতি তার চাকরিতে প্রভাব ফেলেনি। লয়েল্ড ব্যাংকের ভূগর্ভস্থ একটি কক্ষে বাঁধাধরা সময়ের পরিশ্রমের চাকরিটা চালিয়ে গেছেন।

ভূগর্ভস্থ শব্দটি রূপকার্থে ব্যবহার করেননি কির্ক। ব্যাংক সহকর্মী এবং এলিয়টের সাথে দেখা করতে যাওয়া বন্ধুদের বর্ণনা থেকে জানা  যায় এলিয়ট যেখানে কাজ করেছেন সেটা সত্যিই ভূগর্ভস্থ এলাকা। উপন্যাসিক এলউডস হাক্সলি একবার তার সাথে দেখা করতে যান। তার ভাষায়, এলিয়ট যেখানে বসতেন তাকে ঠিক নীচতলা বলা চলে না, এমনকি নীচতলার নীচের অংশও নয়। নীচতলার সিঁড়ি দিয়ে নেমে আরো অনেকটা ভেতরে ভূগর্ভস্থ একটা কামরা। সেখানে নিচু ডেস্কে অন্যান্য কেরানীদের সাথে তার বসার ব্যবস্থা। এমন পরিবেশেও দায়িত্বের সাথে কাজ করেছেন। সোম থেকে শুক্রবার সকাল নয়টা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত অফিসে করেছেন। নিয়মানুযায়ী মাসে এক শনিবার বাড়তি কাজ করেছেন। বছরে ছুটি পেয়েছেন দুই সপ্তাহ। ২৯ থেকে ৩৭ বছর পর্যন্ত এখানে নিবেদিতভাবে কাজ করলেও কোনো পদোন্নতি হয়নি। ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বিস্ময় প্রকাশ করে হাক্সলিকে বলেছেন, এলিয়ট যেভাবে পরিশ্রম করেছেন তাতে তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু  আমি ঠিক বুঝতে পারি না কেন ৯ বছরেও কেরানী থেকে শাখা ম্যানেজার হতে পারেননি এলিয়ট।

রবার্ট ফে তার টি এস এলিয়ট:এমপ্লয়ি অর দা মান্থ প্রবন্ধে লেখকদের পেশা এবং লেখালেখির সমন্বয়ের ইতিহাস তুলে ধরে এর সাথে এলিয়টের তুলনা করেছেন। উইনস্টন চার্চিল, জনাথন ফ্রানজিল, বিল ও রেইলির লেখার সাথে তাদের পেশাগত জীবনের বৈপরীত্যের প্রসঙ্গ টেনেছেন। মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টমাস্টারের চাকরি করার পাশাপাশি সবকিছু উপেক্ষা করে উপন্যাস লেখা চালিয়ে গেছেন উইলিয়াম ফকনার। চার্লস বুকস্কি চাকরি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ডাক বিভাগে। আর্নেষ্ট হেমিংওয়ে কাজ করেছেন প্যারিসে টরেন্টো স্টার উইকলি পত্রিকার বৈদেশিক প্রতিনিধি হিসেবে। পেশার প্রতিকূলতার সাথে কাজের সমন্বয় করেই লেখা চালিয়ে গেছেন দাবী করে রবার্ট ফে প্রশ্ন তোলেন,

টি এস এলিয়টের মত কবি যদি প্রতিদিনের চাকরি সামাল দিয়েও লিখতে পারেন, তবে এই সময়ের লেখকরা নিজেদের খরচ চালোনো নিয়ে এত উদ্বিগ্ন কেন? আমরা জানি, বই আলোচনা এবং মূলধারার উপন্যাসে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য আসে না। লেখালেখির জগতে সাহিত্যবান্ধব চাকরি, যেমন শিক্ষকতার কথা বাদ দিলে বলা যায়, যুগে যুগে লেখকেরা টি এস এলিয়েটের মত কেরানীগিরির মত অ-সাহিত্যিক পেশা বেছে নিয়েছেন। তাদের লেখক জীবন এবং পেশাগত জীবন আলাদা হলেও লেখক জীবনে তারা ছিলেন পুরোপুরি নিবেদিত।

১৯২২ সালে এজরা পাউন্ড, ভার্জিনিয়া উলফসহ ব্লুমবারি গ্রুপের বন্ধুদের মনে হয় ব্যাংকে সময়ের অপচয় হচ্ছে এলিয়টের। সার্বক্ষণিক লেখার সুবিধার্থে চাকরি ছাড়ার পরামর্শ দেন। খরচ চালাতে অর্থ সংগ্রহ করে তহবিল গঠনের কথা ভাবা হয়। ঠিক হয় সবাই চাঁদা দিয়ে বছরে ৫০০ ডলারের তহবিল গঠন করা হবে, যার নাম হবে এলিয়ট ফেলোশিপ ফান্ড। ব্যাকের চাকরী ছেড়ে পুরোদমে লেখালেখি করবেন এলিয়ট, সংসার চলবে তহবিলের টাকায়। এই ফান্ডকে অভিশপ্ত ফান্ড হিসেবে উল্লেখ করে ভার্জিনিয়া উলফ বলেছেন, এই প্রস্তাবে মজা পেয়েছেন এলিয়ট, কিছুটা বিব্রতও হয়েছেন। চাকরি ছাড়ার প্রস্তাবের জবাবে এজরা পাউন্ডকে লেখেন,

আমি নিজেও ব্যাংকের চাকরিটা ছেড়ে দিতে চাই। সারাজীবন এখানে পচে মরতে চাই না। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সারাজীবন এখানে থেকে যাওয়া হবে এক বীভৎস বিষয়। তবে আজকাল আমার সব অনুভূতি ভোতা হয়ে গেছে।  এই চাকরী আমার নিরাপত্তার প্রধান উৎস। ভিভিয়েন আসার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল।ও নিজে উপার্জন করে চলার মত শক্ত মেয়ে নয়। আমার অনেক ভুলের কারণেই ওর এই মানসিক বিপর্যস্ততা। ৫০০ ডলার বেচে থাকার জন্য যথেষ্ট টাকা। কিন্তু আমার মৃত্যুর পর বিধবা অবস্থায় ওর দায়িত্ব কে নেবে? এই চাকরী আমার নিরাপত্তার প্রধান উৎস। এভাবে হঠাৎ করে ব্যাংক ছেড়ে দেওয়াটাও আমার জন্য খুব বেদনার হবে। কেবলমাত্র আমার ও ভিভিয়েনের আজীবন বেচে থাকার মত অর্থের নিশ্চয়তা পেলেই এই ব্যাংকের এই চাকরিটা ছেড়ে দিতে পারি।

বন্ধুদের প্রস্তাব ফিরিয়ে ব্যাংকের চাকরিটা চালিয়ে যান। পাশাপাশি চলতে থাকে শিক্ষকতা। ছুটির সন্ধ্যায়  স্থানীয় কলেজে সাহিত্যের ক্লাস নেন। সেখানে তার ছাত্র- ছাত্রীরা কর্মজীবী। যারা চাকরীর পাশাপাশি পড়াশোনা করছেন। ১৯১৭ সালে ২১শে মার্চ বোন শার্লটকে লেখা চিঠিতে নিজের শিক্ষকতা সম্পর্কে ধারনা দেন।

এই কলেজে আমি পড়াই কর্মজীবী ছাত্রদের। এই কাজে খুব উৎসাহী আমি। মনে হয় বেশ ভাল বক্তা হয়ে উঠেছি। আমার ছাত্ররা, সপ্তাহে একবার যাদের সাথে দেখা হয়, মন নিয়ে আমার বক্তৃতা শোনে, নিবন্ধ লেখে, নিজেদের উন্নয়ন করতে বেশ আগ্রহী তারা। যদিও শেষ পর্যন্ত জীবন যাপনের ধরন উন্নত করতে এই ক্লাস তাদের খুব একটা কাজে আসবে না। তবুও তারা জানতে চায়, পড়তে চায়, মনের খোরাকের জন্য। জ্ঞান অর্জনের জন্য।

কর্মজীবী ছাত্রদের সাহিত্যানুরাগের প্রশংসা করতে গিয়ে তুলনা করেন আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থার ।

আমেরিকায় কর্মজীবী মানুষের জন্য এ ধরনের পড়াশোনার সুযোগ কম। যদিও ওখানেও শিক্ষার প্রসার ঘটেছে এবং সবার জন্যই তথা-কথিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া সহজ। সেখানে শিক্ষা তেমন বহুমূল্য কিছু নয়। একজন তরুণ আমৃত্যু কাজ করে যায়, যেন টাকা উপার্জনই শিক্ষার উদ্দেশ্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে পয়সা রোজগার করেই কাটিয়ে দেবে সারাজীবন। বিদ্যা চর্চার ধারনা সেখানে নতুন। অথচ ইংল্যান্ডে ধনী শ্রেনীর মধ্যে এই চর্চাটা আছে। কিন্তু আমার দেশে আমাদের শ্রেনীর মানুষেরা বিদ্যাচর্চায় নিজেদের নিবেদিত করতে রাজী নয়। সামাজিকভাবেই তাদের নিরুৎসাহিত করা হয়। দুই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে এলিয়টের তুলনায় তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। এ ধরনের বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম অনেক বছর ধরেই আমেরিকার রয়েছে। ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মজীবীদের জন্য এ ধরনের কোর্স চালু আছে।

২৩শে মার্চ সোমবারের সান্ধ্যকালীন ক্লাস, শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নিয়ে চাচাত বোনকে জানান, এটা তার জীবনের অন্যতম আনন্দের বিষয়। বলেন, এখানে পড়াচ্ছেন রবার্ট ব্রাউনিং, কার্লাইল, মেরেডিন, আরনল্ড এবং রাসকিন। এখন তার ক্লাসে খুব কম সংখ্যক কর্মজীবী ছাত্র আছে। শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। তারা প্রয়োজন ছাড়াই শখের বশে বই পড়েন। এক মুদি দোকানী আছে, সে কাজের ফাকে দোকানের সামনে বসে রাসকিনের বই পড়ে। তারা শিল্প সম্পর্কে জানতে খুব উৎসাহী। এই ক্লাসে এসে উজ্জীবিত বোধ করছে এলিয়টের ব্যক্তিগত জ্ঞানের সাথে পরিচিত হয়ে। এই ছাত্রছাত্রীদের মাঝে দুজন পাগল, কয়েকজন চতুর, তার মনে হয় তারা ইংল্যান্ডের খুব আকর্ষণীয় ব্যক্তি। মধ্যবিত্তের মত এরা খুব একটা নাক উঁচু, কুসংস্কারাচ্ছন্ন নয়। আমেরিকানদের কাছে, ইংরেজ কর্মজীবী মানুষেরা খুব আকর্ষণীয়, তাদের আলাপ আলোচনার কারণে। তারা এতটা আক্রমণাত্মক, বিচ্ছিন্ন নয়, আমেরিকান মধ্যবিত্তের মত।

এসব মন্তব্যে আমেরিকান কর্মজীবী মানুষ, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতি বিরূপ ধারনা প্রকাশিত হয়েছে। যেটা তার নিজের শেকড়ের অবমাননা। তিনি নিজেও সে সমাজেরই একজন। সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত পরিবারের সদস্য বলেই হয়ত এটা সম্ভব হয়েছে। আমেরিকায় কখনো তাকে ইংল্যান্ডের মত পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। এখানে পড়াতে গিয়ে জেনেছেন কর্মজীবী মানুষের শিক্ষা সম্পর্কে। আমেরিকার নিরাপদ আর্থ সামাজিক বলয়ে থাকলে এসব ভাবনা তার মাথায় আসত কিনা সন্দেহ। ধীরে ধীরে প্রভাষক হিসেবে দক্ষতাকে শান দিয়েছেন। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে বাবা-মাকে লেখা চিঠিতে জানান, শ্রেণীকক্ষে লিখিত বক্তৃতা নয়, বরং টুকটাক নোট নিয়ে নিজের মত করে কথা চালিয়ে যান। আগের চেয়ে এখন বক্তৃতা দিতে কম কষ্ট হয়, সময়ও কম লাগে। এখন এক ঘণ্টা বা তারচে বেশী সময় ধরে টানা কথা বলে যেতে পারেন।

খুব বেশী পড়াশোনা ছাড়াই বেশ কিছু বিষয় নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করতে পারি। কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই যেকোনো বিষয়ে কথা বলতে পারি। সামান্য নোট থেকে যে অনর্গল কথা বলার শক্তি পাওয়া যায়, তা সত্যি চমৎকার।

১৯২৩ সালে দি ফাংশন অব ক্রিটিসিজম প্রবন্ধে লেখেন, একজন অতিরিক্ত প্রভাষক হিসেবে ছাত্রদের সামনে কথা বলার কিছু অভিজ্ঞতা আমার আছে।  ছাত্রদের সামনে পাঠ্যসূচিকে আকর্ষণীয় করার নির্দিষ্ট করার কিছু কৌশল আছে। ভাল শিক্ষকের মত শ্রেণীকক্ষে অভিজ্ঞতা ও নানা নিরীক্ষার মাধ্যমে পড়াতে শিখেছি আমি।

ব্যাংকের চাকরি এবং সান্ধ্যকালীন শিক্ষকতা নিয়ে আগ্রহের পরও এটা বলাই যায় এই দুই কাজে যতটা উপার্জন হয় তা তাদের  অনিশ্চিত জীবন থেকে কিছুটা মুক্তি দিলেও লন্ডনের মত ব্যয়বহুল শহরে ভদ্রভাবে বাচার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই তখনো থেকে যান শ্বশুরের হ্যামস্ট্যাডের বাড়িতে। সেখানে থেকে বিয়ের অর্জন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে ভিভিয়েনের মনে। স্বামীর সাথে কাটানো দরিদ্র জীবনের সাথে বাবার বাড়ির প্রাচুর্যের তুলনা আসে। শাশুড়িকে লেখা চিঠিতে বাবার বাড়ির খোলামেলা পরিবেশ ও স্বামীর সংসারের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় ব্যাংকের চাকরি নিয়ে স্বস্তিতে থাকা এলিয়টের জীবনে তখনো আসেনি প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক সচ্ছলতা। ব্যাংকে  যোগ দেয়ার পর শাশুড়িকে লেখা চিঠিতে আভাস পাওয়া যায়, যাকে অর্থ রোজগারের পেশা বলছেন, সান্ধ্যকালীন যে নতুন কাজে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এলিয়ট, তা অনেক কর্মঘন্টা দাবী করে। ১৯১৭ সালের ২৮ জুন হ্যামস্ট্যাডের বাবার বাড়ি থেকে লেখা চিঠিতে এই বাস্তবতার আভাস পাওয়া যায়। বাবার বাড়ির কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,

বাড়িটা টমের খুব পছন্দ। কক্ষগুলো বেশ বড়, বাতাসের অবাধ আসা যাওয়া। এখানে থাকতে বেশ পছন্দ করে এলিয়ট। শান্ত পরিবেশ, চারপাশের নির্জনতা, বাড়ির সামনে চারকোনা সবুজ মাঠ। আকর্ষণীয় পরিবেশ ছাড়াও এখানে থাকার অন্যতম কারণ বিনা পয়সায় থাকা খাওয়া। লন্ডনে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে গেলে বেশ খরচ হয়। বাবা তার চাকর বাকড়দের কাছ থেকেও থাকা খাওয়ার টাকা নেন না।

চিঠি পড়ে মনে হয়, ভিভিয়েন বুঝতে পেরেছেন এই বিয়ে তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে। স্বামীর অসচ্ছলতার কারণে বিয়ের পর তাকে নিয়ে পৈত্রিক বাড়িতে এসে ওঠা, বাবার গলগ্রহ হয়ে থাকার গ্লানি থেকে তৈরি হয়েছে সংকোচ, অস্বস্তি। শাশুড়ির কাছে এসব অস্বস্তির কথা তুলে ধরেন দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত ভিভিয়েন।

আমার খুব অবাক লাগে, আমি আবার নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছি। টমকে নিয়ে। বিয়ের পর থেকে টানা দুই বছরের সংগ্রাম,  কোলাহলের পরিবেশে থাকতে থাকতে ভুলেই গিয়েছিলাম যে জীবন আবারো এত চমৎকার, মসৃণ হয়ে উঠতে পারে। এখানে আসার পর আবারো মনে হচ্ছে জীবন খুব সুন্দর। সেই পুরনো গল্পের কথা মনে পড়ছে। কোনো কিছু না হারালে তার মর্যাদা বোঝা যায় না। বিয়ের আগে এই বাড়িতে থাকার সময় এমন অনুভূতি কখনো হয়নি। একই চিঠিতে জানান, যে ফ্লাটে সংসার পেতেছিলেন সেখানকার পরিবেশ প্রসঙ্গে,_

আমরা থাকতাম ঘিঞ্জি একটা এলাকায়, কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে। ক্রাফোর্ড ম্যানসনে আমাদের ছোট্ট ফ্লাট। পাশে বস্তি; নিচু রাস্তা।  চারপাশে গরীব মানুষের দোকানপাট। কেমন বন্য একটা পরিবেশ। আশেপাশের কেউ চেনে না আমাদের। আমাদের নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই কারো। আমরা কে, কি করি, বেচে আছি না মরে গেছি, কারো কিছু এসে যায় না।

কিছুটা নাটকীয় হলেও এই বর্ণনায় উঠে এসেছে সংসারের প্রকৃত অবস্থা। বেপরোয়াভাবে শাশুড়িকে নিজেদের দৈন্যতা জানানোর কারণ অর্থনৈতিক সাহায্যের আশা। সেজন্যই তুলে ধরেছেন দরিদ্র জীবনের বয়ান। এতদিনে অনেকটাই বৈষয়িক হয়ে উঠেছেন কবিপত্নি। অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান তার স্বামী। তার মনে হয়েছে প্রিয় সন্তানের দুর্দিনে হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন না মা। এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। ১৯১৭ সালের ২২ অক্টোবর টমের মাকে লেখা ফিরতি চিঠির শুরুতেই ধন্যবাদ জানিয়েছেন টমের অন্তর্বাসের জন্য টাকা পাঠানোর জন্য। এই চিঠিতে ভিভ জানান যুদ্ধবিধ্বস্ত লন্ডনে কতটা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি তারা। অনেকদিন ধরে ছোট একটা কমদামী কটেজ খুঁজছেন। লন্ডনের কাছাকাছি কোনো এলাকায় যেন টম এটার খরচ চালাতে পারে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সামর্থ্যের মধ্যে একটা কটেজ পাওয়া যায়। লন্ডনের নিকটবর্তী স্টেশন থেকে ছয় মাইল দূরে। শুধুমাত্র ছুটির দিনগুলোতে এখানে আসতে পারে টম ।

জায়গাটা খুব সুন্দর। রুপকথার মত ছোট পুরনো বাড়ি। অনেকটা ফার্ম হাউসের মত। আমাদের মনে হয় এটা ইংল্যান্ডের সবচে সুন্দর বাড়ি। পাশে উঁচু পাহাড়। চারপাশে পাইন গাছ। জঙ্গলের মাঝে এখানে সেখানে ছোট ছোট ঝোপঝাড়। ভিভ জানান, মে মাসের মধ্যে এই বাড়িতে পাকাপাকিভাবে থাকা যাবে। ক্রাফোর্ড ম্যানসনের ফ্লাটটাও ছাড়তে পাচ্ছেন না। অনেক প্রয়োজনীয়  উপকরণ, আসবাব, বিশেষ করে টমের বইগুলো ওখানে আছে। ভিভিয়েন বলেন, বাধ্য হয়েই ফ্লাটটা রাখতে হচ্ছে। এখান থেকে ৫০ থেকে ১০০ টি বই বড়জোর নিয়ে আসা যায়। এছাড়া ওর টাইপ রাইটার, অফিসের অন্যান্য কাগজপত্রও আছে। স্বামীর শিক্ষকতা সম্পর্কেও ধারনা দেন শাশুড়িকে। সপ্তাহে দুদিন কলেজে বক্তৃতা করে টম। কলেজটা লন্ডনের শেষ মাথায়। শহরের ঠিক বিপরীতে। অন্তত দুরাত সেখানে কাটাতে হয় তার। সে সময় এই গ্রামীণ বাড়িতে থাকেন ভিভ। লন্ডনের ফ্লাটে এলিয়টের একা থাকা নিয়ে দুশ্চিন্তাও হয়। তবে একজন দক্ষ রাঁধুনি পাওয়া গেছে যে অনেক মানবিক। তার অনুপস্থিতিতে টমের খাওয়া দাওয়ায় কোনো সমস্যা হবে না ভেবে স্বস্তি পায় ভিভেয়েন।

ভিভিয়েনের এই দুশ্চিন্তা সাময়িক। এ চিঠিগুলো লেখা হয়েছে এলিয়ট ব্যাংকে যোগ দেয়ার পর পর। তখনো থিতু হয়ে উঠতে পারেননি কবি। ধীরে ধীরে বেড়েছে আয়, গুছিয়ে নিয়েছেন সংসার। কিন্তু সচ্ছলতা ও প্রতিষ্ঠা আসার সম্পর্কে  তৈরি হয় দূরত্ব, ভিভ ছিটকে পড়েছেন কবির জীবন থেকে। ১৯২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত এই ব্যাংকে কাজ করেছেন এলিয়ট। এই ৯ বছরে বদলে গেছে জীবন। এলিয়ট এখন লন্ডনের বিখ্যাত কবি। তার মত একজন প্রতিষ্ঠিত লেখককে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয় লন্ডনের প্রকাশনা সংস্থা ফেবার এন্ড গেয়ার। ১৯২৫ সালের ২৮শে এপ্রিল ফেবার এন্ড গেয়ারে যোগ দেন। ফেবারের অফিস রাসেল স্কোয়ারে। এটি  ভিক্টোরীয়ান ধনী পরিবারের মালিকানাধীন বাড়ি। ৫ তলা ভবনের ওপরতলায় তলায় এলিয়টের কক্ষ। এখানে যোগ দেয়ার পর লেখালেখি কেন্দ্রিক জীবন কেটেছে। যোগাযোগ হয়েছে ইংরেজ লেখকদের সাথে। এতদিন নিজের লেখা নিয়ে ব্যস্ত  থেকেছেন। এখন অন্য লেখকদের বই ছাপা, পাণ্ডুলিপি যাচাই বাছাইয়ের সঙ্গে যুক্ত হন।

এই প্রকাশনা সংস্থার শুরু থেকেই কাজ শুরু করেন এলিয়ট। ফেবারের প্রতিষ্ঠাতা, চেয়ারম্যান জিওফ্রেরি ফেবার। যোগ দিয়েছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। কাজ করেছেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসে। ভালবাসেন সাহিত্য, টুকটাক লেখালেখিও করেন। লেখেন গল্প, কবিতা। এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মূল মালিক তার প্রয়াত শ্বশুর সার হেনরি বারডেটে। এক সময় এখানে ছাপা হয়েছে স্বাস্থ্য, চিকিৎসা বিষয়ক বইপত্র, মেডিকেল কলেজের পাঠ্যপুস্তক। হেনরির মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠান দা সাইন্টিফিক প্রেসের দায়িত্ব পান তার মেয়ে লেডি গেয়ার। ১৯২৪ সালে জিওফ্রেরি ফেবার এ চেয়ারম্যান হন।  চিকিৎসা বিষয়ক বইয়ের বাইরে একটি মূলধারার প্রকাশনা হিসেবে ফেবারকে পরিণত করার কথা ভাবেন। শ্বশুরের প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেন। নতুনভাবে নামকরণ করেন ফেবার এন্ড গেয়ার। তার পরিচালনায় এটি হয়ে ওঠে লাভজনক এক প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে ছাপা হয় বিশ্বসেরা লেখকদের বই। প্রতিষ্ঠার পর একজন সাহিত্য উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়ার কথা ভাবেন জিওফ্রেরি। এই পদে এমন একজনকে চেয়েছেন সাহিত্য জগতের সবার সাথে ভাল জানাশোনার পাশাপাশি যার রয়েছে ব্যবসায়িক বুদ্ধি; যিনি খুব নির্জনতার বাস করেন, যেন নি:সঙ্গ পাহাড় চুড়ায় বসে থাকা একাকী মানুষ।

সাংবাদিক চার্লস হুইবলি নাম প্রস্তাব করেন এলিয়টের। রাতের খাবারের আমন্ত্রণ জানানো হয় কবিকে। প্রথম আলাপে মুগ্ধ ফেবার তাকে পরিচালনা পরিষদের সদস্য হিসেবে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেন। এ পর্যন্ত যত যে কটা চাকরির সুযোগ এসেছে এটি সবচেয়ে সম্মানজনক। অর্থনৈতিক কারণে ব্যাংকে পড়ে থাকলেও সেখানে ছিল না, সৃষ্টিশীল পরিবেশ, মানসিক সংযোগ। ফেবারে যোগ দেয়ার মাধ্যমে এলিয়ট মুক্তি পান ভূগর্ভস্থ এলাকা থেকে। শুরু হয় এক নতুন এক অধ্যায়। যে অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইংল্যান্ডের প্রকাশনা সাহিত্যের ইতিহাস। এতদিন ব্যাংকে কাজ করেছেন, সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যিক পত্রিকা, এই প্রথম ভিন্ন ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। ফেবারের প্রথম ক্যাটালগে স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা বিষয়ক বইয়ের সূচি ছাড়াও এলিয়টের বইয়ের তালিকা ছাপা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ১৯০৯ থেকে ১৯২৫ পর্যন্ত লেখা কবিতা, ওয়েষ্টল্যান্ড, দা হলো ম্যান, তার এ পর্যন্ত লেখা সব কবিতা যা তিনি সংরক্ষণ করতে চেয়েছেন। ধীরে ধীরে সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের বই প্রকাশের উদ্যোগ নেন এলিয়ট। ছাপেন এজরা পাউন্ডের নির্বাচিত কবিতা। পাউন্ডের কবিতা নিয়ে দীর্ঘ ভূমিকাও লেখেন। এর আগে নিজের সম্পাদিত পত্রিকা ক্রাইটেরিয়নে নিয়মিত ছেপেছেন পাউন্ডের লেখা। ১৯২২ সালে প্রকাশিত প্রথম সংখ্যায় ছেপেছেন ওয়েস্টল্যান্ড। প্রথমে নিজের আলাদা অফিস না থাকায় বাসায় এবং ১৯৩৯ সালে পত্রিকাটি বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত ফেবার অফিসেই চলে পত্রিকাটির কাজ। এই কাগজে ডব্লিউ বি অডেন, এম্পসন, স্টিফেন স্পেন্ডারের প্রথম দিকের লেখা ছাপা হয়। এছাড়া ইউরোপীয় কবি মারসলে প্রাউস্ট, পল ভালেরির মত অনেক বিদেশী লেখকের লেখাও এখানে তুলে ধরা হয়। ফেবারে যোগ দিয়ে ফরাসী ও জার্মান লেখকদের পাণ্ডুলিপি পড়তে শুরু করেন। সিদ্ধান্ত নেন ইউরোপীয় মনিষীদের জীবনী প্রকাশের। এসব উদ্যোগ ভাল লাগেনি তার বন্ধু উপন্যাসিক ভার্জিনিয়া উলফের। ফেবারের উন্নতিরে সাথে  দুশ্চিন্তা বাড়ে তার। এই প্রতিষ্ঠানকে মনে হয় হোগার্থের প্রতিদ্বন্দ্বী। মনে হয় তার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হোগার্থ প্রেসকে পেছনে ফেলে ফেবারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে উঠেপড়ে লেগেছেন তার কবিবন্ধু। বিশেষ করে ফেবার থেকে একের পর এক আধুনিক কবিদের গ্রন্থ প্রকাশে নিজের প্রকাশনার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন উলফ। ফেবার প্রতিষ্ঠার আগে এলিয়টের কবিতা ও ওয়েস্টল্যন্ড ছেপেছেন উলফ। এখন শুধু তার পাণ্ডুলিপি নয়, অন্য লেখকদের লেখা পাওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়।

ফেবারের পরিচালনা পরিষদে আরো রয়েছেন রিচার্ড  ডি লা মারে, ফ্রান্ক মর্লি। পেশাদারিত্বের বাইরে তাদের মাঝে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব।  পরস্পরকে পড়ে শোনান নিজেদের লেখা। এ রিচার্ড  ডি লা মারে তার এক পারিবারিক বন্ধু সেইগফ্রিড সাজগের লেখা মেরোরিজ অব এ ফক্স হিউম্যান হান্টিং ম্যান প্রকাশের উদ্যোগ নেন। বিক্রির রেকর্ড ছাড়িয়ে যায় বইটি। ফেবারের আরেক অধিক বিক্রীত বই লর্ড অব দ্যা ফাইলস। চার্লস মনটিথের লেখা বইটি ২০ টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ফিরিয়ে দেয়ার পর ফেবার বইটি ছাপে এবং লাভের মুখোমুখি হয়। আইরিশ লেখক জেমস জয়েসের ইউলিসিস ছাপার উদ্যোগ নেন এলিয়ট। কঠিন দারিদ্রতার ভেতর দীর্ঘ আট বছর ধরে উপন্যাসটি লিখেছেন জয়েস। ১৯২০ সালে প্যারিসে পরিচয়, এরপর বন্ধুতা। শুরু থেকেই জয়েসের লেখা ভাল লাগে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হবার পর বন্ধুর বই ছাপার কথা ভাবেন। এই উপন্যাসটি ওয়েস্টল্যান্ডের সমসাময়িক লেখা। শুরু থেকে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখী হয়েছে বইটি। এমন নাটকীয় প্রকাশনা ও বিতর্কের ইতিহাস খুব কম বইয়ের ক্ষেত্রে ঘটেছে। নিজের সম্পাদিত পত্রিকা ক্রাইটেরিয়ানের প্রথম সংখ্যায় ছাপেন ইউলিসিসের প্রথম কিস্তি। ১৯৩১ সালের জুলাই মাসে ফেবারের পরিচালক হিসেবে এলিয়ট যোগাযোগ করেন জয়েসের সাথে। ১৯২০ সালে প্রকাশের পরপরই মার্কিন আদালতের রোষানলে পড়ে এই উপন্যাস। অবাধ যৌনতার অভিযোগে উপন্যাসটি ১২ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে আমেরিকান সরকার। আদালত রায় দেয়- এটি বিপদজনক গ্রন্থ। একে পাঠকের নাগালের বাইরে রাখা উচিত। ১৪ বছরের জন্য বইটি নিষিদ্ধ করে যুক্তরাজ্যও। নিষিদ্ধ হলেও গোপনে দু দেশেই চোরাপথে বিক্রি হতে থাকে এই বই। ১৯২২ সালে প্যারিসে আমেরিকান প্রকাশক শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানী ছাপে এর প্রথম সংস্করণ। হু হু করে বিক্রি হতে থাকে ইউলিসিসের লন্ডন সংস্করণ। প্রথম থেকেই বইটি নিয়ে নানা জটিলতায় তিন বন্ধু এলিয়ট, পাউন্ড এবং হেমিংওয়েকে পাশে পেয়েছেন জেমস। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে নিজের সবচে পরিশ্রমের ফসল, সেরা লেখা নিষিদ্ধ হওয়ার পর যখন ভেঙে পড়েছেন জেমস, এমন পরিস্থিতিতে এলিয়ট জয়েসকে জানান, যত দ্রুত সম্ভব তার উপন্যাসের লন্ডন সংস্করন ছাপার উদ্যোগ  নেয়া হবে। তবে এলিয়টের ইউলিসিস ভক্তির প্রতি সমর্থন থাকলও ফেবারের চেয়ারম্যান জিওফ্রেরী প্রথমে বইটি  ছাপতে রাজী হননি আইনি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ভয়ে। বন্ধুর প্রতি অগাধ আস্থায় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন জেমস। তার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ১৯৩৪ সালে ফেবার থেকে প্রকাশিত হয় ইউলিসিস। যে বইটিকে নিয়ে এত নিষেধাজ্ঞা সেই ইউলিসিস বিশ শতকের শেষের দিকে বিশ্বের বিভিন্ন  কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্য হয়। লেখকের স্পর্ধা এবং ভাষার কাব্যিক কাঠামো নজর কাড়ে সমালোচকদের। হোগার্থ  থেকে ইউলিলিস ছাপার জন্য ভর্জিনিয়া উলফের কাছে অনুরোধ আসলে তিনি রাজী হননি। গল্প পড়ে ভাল লাগেনি, দৈর্ঘ্যও বড় বেশী মনে হয়েছে। মনে হয়েছে এটি একটি স্থূল উপন্যাস, লেখক অশিক্ষিত, স্বনির্মিত এক কর্মজীবী মানুষ। ইউলিসিস না ছাপার সিদ্ধান্ত  জানিয়ে ১৯১৮ সালে লেখা চিঠিতে হেরিয়েট শ ওয়েভারকে ভার্জিনিয়া উলফ লেখেন,

এই উপন্যাস প্রকাশের পথে বড় বাধা এর দৈর্ঘ্য। আমার প্রকাশনীর পক্ষে এত ঢাউস বই ছাপা কঠিন। আমাদের কাজের যা অবস্থা তাতে ৩০০ পৃষ্ঠার বইটি ছাপতে কমপক্ষে দুই বছর লেগে যেতে পারে, যা তোমার ও মিস্টার জয়েসের পক্ষে মেনে নেয়া মুশকিল হতে পারে।

কেউ কেউ এমনও বলেছে যে এর লেখক মেধাবী কিন্তু নোংরা মানসিকতার লোক। সকল সমালোচনার জবাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে জয়েস বলেছেন, তার এই বই মানবদেহের মহাকাব্য।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফেবার হয়ে ওঠে আধুনিক লেখকদের প্রাণকেন্দ্র। এখান থেকে বই প্রকাশের পর লেখক হিসেবে পরিচিতি গড়ে ওঠে অনেকের। তখনকার তরুণ লেখকদের কাছে ফেবার হয়ে উঠে স্বপ্নের নাম। নিজের বই ছাপার জন্য ফেবারের সাথে যোগাযোগ করেন অনেকে। তেমনই এক লেখক ডব্লিউ এইচ অডেন। ছাত্রজীবন থেকে ফেবারের পেছনে ধর্না দিতে থাকেন। ১৯২৭ সালে অক্সফোর্ডে পড়ার সময় ডাকে পাঠান কিছু কবিতা। কবিতাগুলো বাতিল করে দিলেও তরুণ কবিকে নিরাশ না করে জানান, তোমার আরো লেখা পড়তে চাই। ১৯২৯ সালে পেইজ অন বোথ সা ইড মনোনীত করেন ক্রাইটেরিয়নে ছাপার জন্য। এত প্রত্যাখ্যানেও হাল ছাড়েননি অডেন। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকেন। প্রতি বছর পাঠাতে থাকেন নতুন কবিতা। ১৯৩০ সালের বসন্তে আবারো কিছু কবিতা পাঠান অডেন। এবার মন গলে এলিয়টের। মনে হয় ফেবারের লেখক তালিকায় এবার যুক্ত করা যায় এই তরুণের নাম। তিন বছর পর ফেবার থেকে ছাপা হয় ডব্লিউ এইচ অডেনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। অডেন সম্পর্কে এলিয়ট বলেছেন, শুধুমাত্র সাহিত্যিক যোগ্যতা নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়ে তার আগ্রহের কারণে শুরু থেকেই অডেনকে গুরুত্ব দিয়েছি। একই বছর সিদ্ধান্ত নেন স্টিফেন স্পেন্ডারের কবিতা ছাপার। স্পেন্ডার সম্পর্কে তার মূল্যায়ন- সে একজন শিশুর মত। তাকে নিয়ে আমি আশাবাদী। ১৯৩৩ সালে ছাপেন এজরা পাউন্ডের ক্যন্টোসের পনেরতম পর্ব। ১১৬ পর্বে লেখা ক্যান্টসকে বলা হয় বিশ শতকের অন্যতম আধুনিক কবিতা। ১৯১৫  থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত  মোট ১১৬টি পর্ব লেখেন পাউন্ড। মানসিক ভারসাম্য হারানোর সময়ও এই লেখা সঙ্গী ছিল তার। সুস্থ হওয়ার পর আবার লিখেছেন। পাউন্ডের সাথে তার সখ্যতা সত্ত্বেও তার বই ছাপার জন্য সুপারিশ করেন জেমস জয়েস ও আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। ১৯৩৯ সালে ছাপা হয় ক্যন্টোসের আরো কিছু খণ্ড। পাউন্ডের নির্বাচিত কবিতা প্রকাশের দশ বছর পর ১৯৩৮ সালে বুক কমিটির কাছে রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে লেখা প্রবন্ধ গাইড টু কালচার প্রকাশের আগ্রহ প্রকাশ করেন এলিয়ট। নিজের জীবনে পাউন্ডের অনবদ্য ভূমিকাকে মনে রেখেছেন এলিয়ট। বারবার ঋণ স্বীকার করেছেন। নানা বিপর্যয়ে চেষ্টা করেছেন পাশে থাকার। পাউন্ডের গুরুত্বপূর্ণ সব বই ছেপেছেন ফেবার থেকে। একগুঁয়ে, জেদী, উদ্ধত আচরণের জন্য অন্য প্রকাশকদের সঙ্গে যখন সম্পর্কের অবনতি ঘটছে, তখন পাউন্ডের মত কঠিন লেখককে ভালভাবে সামলে নিয়েছেন এলিয়ট। এর পেছনে কাজ করেছে পাউন্ডের প্রতি গভীর মমতা। ক্যান্টোসের ফ্ল্যাপও লেখেন। ভূমিকা লেখেন নির্বাচিত কবিতার। গাইড টু কালচার বই সম্পর্কে এলিয়ট বলেন, আমরা পাউন্ডকে এই বইটি লেখার প্রস্তাব দেই। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাণ্ডুলিপিও পেয়ে যাই। একমাত্র কালচারের মানুষেরাই এই বই নিয়ে তার মনোভাব বুঝতে পারবেন। এখানে রাজনীতি এবং দর্শন নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা রয়েছে।

এলিয়টের মত প্রভাবশালী কবির উপস্থিতি ফেবারের প্রচারণায় বেশ কাজে আসে। ত্রিশের দশক থেকে ফেবার হয়ে ওঠে শতাব্দীর সেরা লেখকদের প্লাটফর্ম। এখান থেকে প্রকাশিত হয় সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের বই। এলিয়টের এ্যাশ ওয়েডনেসডে, মার্ডার ইন দা ক্যাথেড্রাল ছাড়াও বেশ কিছু সমালোচনা গ্রন্থও ছাপা হয়। পাউন্ড, অডেন ছাড়াও এলিয়ট গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছেন মেরিয়েন মুর, লুইস মেকনিসের কবিতা। ফেবারের মত বড় প্রকাশনী থেকে বই ছাপার পর কবি হিসেবে পরিচিত তৈরি হয় মেকনিসের মত অনেক তরুণ লেখকের। শুরু থেকেই লুইস মেকনিসের কবিতা ভাল লেগেছের এলিয়টের। তবে ফেবার থেকে বই প্রকাশের জন্য ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করত হয়েছে এই তরুণ কবিকে। শুধু মেকসিন নয়, যাদের লেখা ভাল অথচ পরিচিতি নেই এলিয়ট তাদেরও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এই তালিকায় রয়েছেন এস্পসন, গ্রেভস, ওয়ালেস স্টিভেন্স। এভাবেই প্রকাশনা সংস্থা হয়েও বিশেষ ধারার কবিতার বিকাশে ভূমিকা রাখে ফেবার। পাশাপাশি এসব লেখকের বই হয়ে ওঠে সর্বাধিক বিক্রীত বই। তবে কবিতা এবং প্রবন্ধ ফেবারের মানদন্ড ও পরিচিতি নির্মাণে ভূমিকা রাখলেও আয়ের উৎস হয়ে উঠেছে অন্য ধরনের বই। পরিসংখ্যান বলে, দশকের পর দশক ধরে পাউন্ড বা এলিয়টের মার্ডার ইন দা ক্যাথেড্রাল বা নির্বাচিত কবিতা বিক্রি হয়েছে এক হাজারের মধ্যে একশত কপি। সে তুলনায় স্বাস্থ্য বিষয়ক বইয়ের কাটতি ছিল বেশী। ফেবারের তারকা লেখক ইভলিন পীয়ার্স, পেশায় নার্স। লন্ডনের মিডলসেক্স হাসপাতালের নার্স প্রশিক্ষক ইভলিন লেখক সম্মানী পেয়েছেন এলিয়টের চেয়েও বেশী। সত্তরের দশকে সেরা বিক্রির তালিকায় দেখা যায়  লরেন্স ডুয়েলসের আলেকজান্দ্রিয়া কোয়ার্টেট, উইলিয়াম গডলিংসের লর্ড অব দা ফাইলস এবং এলিয়েটের মার্ডার ইন দা ক্যাথেড্রাল। বিক্রির তালিকায় চতুর্থ বই এনাটমি এন্ড সাইকলজি অব নার্স। এই বইটি বিক্রি হয়েছে অর্ধ লক্ষ কপি। ১৯৭০ সালে ফেবার যোগ করেছেন টেড হিউজের নাম। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি তালিকার শীর্ষে চলে আসে টেড হিউজের কবিতা। ১৯৮৮ সালে এখান থেকে ছাপা হয় টেডের বার্থ ডে লটার্স। প্রকাশক হিসেবে এটি এলিয়টের বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। টেড হিউজের পাশাপাশি তার স্ত্রী, কবি সিলভিয়া প্লাথও যোগ হয়েছেন ফেবারের লেখক তালিকায়। যদিও প্রথমদিকে পরিচিতি তৈরি হয়নি টেড হিউজকে বিয়ে করে আমেরিকা থেকে লন্ডনে এসে থিতু হওয়া প্লাথের। ফেবার থেকে ছাপা হয়েছ তার এরিয়েল ও আত্মজৈবনিক উপন্যাস বেলজার। টেড হিউজসহ অনেক লেখকের কাছে শুধু প্রকাশক নন, এলিয়ট হয়ে উঠেছেন অভিভাবক। ১৯৬৫ সালে এলিয়টের মৃত্যুর খবর পেয়ে মাথার ওপর ছায়া সরে গেছে বলে মনে হয় হিউজের। ডায়েরীতে লেখেন,

তিনি আমার গুরু। মাথার ওপর নিরাপদ ছায়া। আমার চিন্তা ভাবনায় তাকে এতটাই জড়িয়ে ফেলেছি যে, স্বপ্ন ও ভবিষ্যতের সাথে তাকে এতটাই আত্মীকরন করেছি যে তার মৃত্যু আমার জন্য বড় আঘাত। খবরটা শুনে অনিরাপদ বোধ করছি, মনে হচ্ছে  ঝড়ের মুখে পড়েছি। আমার কাছে সব সময় তিনি ছিলেন একজন শক্তিমান পিতা।

তরুণ কবির এই বর্ণনা থেকে লেখকদের ওপর তার প্রভাব সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। ফেবারের পরিচালক হিসেবে অনেক নতুন লেখকের প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছেন এলিয়ট। আবার বিশেষ বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ বইও ফিরিয়ে দিয়েছেন। যে এলিয়ট অনেক সমালোচনা, বিতর্কের পরও ইউলিসিস ছাপতে প্রভাবিত করেছেন ফেবারের চেয়ারম্যানকে; তিনিই অর্থনৈতিকভাবে লাভের সম্ভাবনা সত্ত্বেও ফিরিয়ে দিয়েছেন এনিমেল ফার্মের পাণ্ডুলিপি। ১৯৪৪ সালে জর্জ অরওয়েল এনিমেল ফার্মের পাণ্ডুলিপি পাঠান এলিয়টের কাছে। জানতে চান ফেবার থেকে ছাপা হতে পারে কিনা। উপন্যাসটির ভাষা, আঙ্গিক এবং গদ্যকাঠামোর প্রশংসা করলেও রাজনৈতিক কারণে বইটি প্রত্যাখ্যান করেন কবি। পশুদের নিয়ে লেখা এই উপন্যাসে স্ট্যালিনবাদকে নিয়ে বিদ্রূপ করা হয়েছে। স্ট্যালিনকে এখানে চিহ্নিত করা হয়েছে রাজদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক হিসেবে। এমন এক সময়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এলিয়ট যখন জার্মানির বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে একজোট হয়েছে ব্রিটেন। বইটি ছেপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্যর মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে ক্ষেপাতে চাননি এলিয়ট। এলিয়টের আগে আরো চারজন প্রকাশক বইটির পাণ্ডুলিপি ফিরিয়ে দিয়েছেন। ১৯৪৪ সালের ১৩ জুলাই লেখা চিঠিতে অরওয়েলকে উপন্যাস না ছাপার কারণ ব্যাখ্যা করেন।

প্রিয় অরওয়েল,

আমি জানি, এনিমেল ফার্ম নিয়ে আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন আপনি। কিন্তু এজন্য অন্তত দুজন পরিচালকের মতামত দরকার। যা এক সপ্তাহে সম্ভব নয়। আমি চেয়ারম্যানকেও বইটি পড়তে বলেছি। অন্য পরিচালকরাও প্রধান বিষয়গুলো নিয়ে আমার সাথে একমত। স্বীকার করছি, এটি একটি উল্লেখযোগ্য লেখা। গল্প সাজানো হয়েছে দক্ষ হাতে। বর্ণনাও পাঠকের মনযোগ ধরে রাখার মত। গালিভারের পর খুব অল্প লেখক এমনটা পেরেছেন।

তবে, আমাদের মনে হয় না রাজনৈতিক সমালোচনার এটা উপযুক্ত সময়। যেকোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের এটা দায়িত্ব- অর্থনৈতিক লাভ ছাড়াও আরও কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া। বইটি নিয়ে আমার অসন্তোষ অস্বীকারের বহি:প্রকাশ। লেখকের প্রতি সহানুভূতি রেখেই বলা যায়, ট্রটস্কিকে নিয়ে এমন দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বাসজনক নয়। আপনি নিজেই আপনার প্রতি সৃষ্ট সমর্থনকে ভেঙে দিয়েছেন। খাটি সাম্যবাদ থেকে যারা রাশিয়ার সমালোচনা করে আর যারা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করে তারা উভয়েই ছোট দেশগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে সচেতন। আপনার শুকরগুলো অন্যান্য প্রাণী থেকে বুদ্ধিমান। খামার পরিচালনা করার জন্য বেশী যোগ্য। আসলে তাদের ছাড়া প্রাণীদের খামার গড়া সম্ভব নয়। তাই খাটি সাম্যবাদের চেয়ে দরকার মানুষের প্রতি নিবেদিত শুকরের।

আমি খুব দু:খিত। কারণ এই বইটি যে প্রকাশ করবে স্বাভাবিকভাবেই সে আপনার পরের বইগুলো প্রকাশের অনুমতি পাবে।  এই  লেখাকে আমি শ্রদ্ধা করি। কারণ এটা একটি ভাল বই যার ভিত্তি ন্যায়পরায়নতা।

তবে পরে এলিয়টের মনোভাবে প্রভাবিত হয়ে এনিমেল ফার্ম না ছাপাকে ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করেছে ফেবার কর্তৃপক্ষ। তারা যে বইয়ের পাণ্ডুলিপি ফিরিয়ে দিয়েছেন তা পরে বিক্রি তালিকার শীর্ষে থেকেছে, সর্বোচ্চ মনোযোগ পেয়েছে পাঠক, সমালোচকদের, অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। ইংল্যান্ডের মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক নষ্ট না করার অজুহাতে এমন একটি অসাধারণ বই হাতছাড়া করার জন্য আফসোস করেছেন কর্তৃপক্ষ।

নিয়মিত অফিস করেছেন এলিয়ট। যোগ দিয়েছেন বুধবারের বই কমিটির বৈঠকে। ১৯২৫ সালে ফেবারের নেতৃত্বে গঠন করা হয় এই কমিটি। সকাল এগারটায় শুরু হয়ে শেষ বিকেল পর্যন্ত চলেছে বৈঠক। সবাই ক্লান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত চলেছে আলোচনা। দুপুরের খাবার রান্না হয়েছে অফিসেই। রান্না করেছেন বাড়ির তত্ত্বাবধায়কের স্ত্রী মিসেস লিস্টার। এখানে তারা আলোচনা করেছেন কি ছাপা হবে কি ছাপা হবে না। যাচাই বাছাই করেছেন বিভিন্ন লেখা। কথা বলেছেন জমা পড়া পাণ্ডুলিপি নিয়ে। নির্বাচিত পাণ্ডুলিপি নিয়ে সবাই মতামত দিলেও একেকজন পরিচালক এক একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন। ফেবারের চেয়ারম্যান কাজ করেছেন রাজনৈতিক ও সামরিক বিষয়ক বই নিয়ে। এসব বিষয়ে তার জানাশোনা অন্যদের চেয়ে ভাল। এছাড়া গোয়েন্দা ও রহস্য উপন্যাস নিয়েও তার সিদ্ধান্ত প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। রিচার্ড ডি লা মারে বাছাই করেছেন খামার ও আঞ্চলিক গ্রন্থ। এলিয়ট কাজ করেছেন কবিতা নিয়ে। এছাড়া বিদেশী ভাষার বই বাছাইয়ের দায়িত্বও তাকে দেয়া হয়েছে।  এসব বই ছাপা হত ইংরেজিতে অনুবাদে। প্রথমে কোনো পরিচালক একটি বইয়ের নাম প্রস্তাব করলে কমিটির বাকী সদস্যরা সেই বই পড়ে দেখেছেন, দীর্ঘ আলোচনা পর কমিটির সাধারণ সম্পাদক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বই ছাপা বা প্রত্যাখ্যানের। ১৯৫০ সালের আগ পর্যন্ত অনেকটা নারীশূণ্য রয়ে গেছে ফেবার। পুরুষ প্রধান আড্ডায় প্রাণ খুলে কথা বলেছেন এলিয়ট। ব্যক্তিত্বের  বর্ম  ভেঙে  প্রকাশিত হয়েছে সারল্য। নারী সেক্রেটারি ভালেরি ফ্লেচার যোগ দেয়ার পর পরিবেশে কিছুটা পরিবর্তন আসে। ফেবারের পরবর্তী চেয়ারম্যান পিটার ডু মোটর স্মৃতিচারণে জানা যায়, অভিজাত এই আমেরিকান ভদ্রলোক অশ্লীল গল্প বলা কতটা বলাটা উপভোগ করতেন। শুধুমাত্র যারা তার সাথে কাজ করেছেন তারাই পেয়েছেন এই কৌতুকপূর্ণ স্বভাবের পরিচয়। হাসি তামাশায় ডুবে থাকা এ এক ভিন্ন এলিয়ট। পঞ্চাশের দশকে ষাট বছরে পা দেয়ার পর স্বাস্থ্যগত সমস্যার কাজ অনেকটা কমিয়ে দেন। যেমন অফিসের একঘেয়ে কর্ম বিবরণী, গোয়েন্দা উপন্যাস পড়া বাদ দেন যা এতদিন তাকে পড়তে হত। এসব কাজ থেকে মুক্ত হওয়ার হাতে অবসর আসে। নিজে কবি বলে সব সময় কবিতার বইয়ের প্রতি বাড়তি মনেযোগ দিয়েছেন। ছেপেছেন সমকালীন সব গুরুত্বপূর্ণ কবিদের বই পরিচালক পদে এলিয়টের মত লেখক থাকায় অন্যান্য লেখকদের সাথে সহজ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে ফেবারের। ব্রিটিশ প্রাবন্ধিক ফ্রেডরিখ টমলিন তার টি এস এলিয়ট: এ ফ্রেন্ডশিপ গ্রন্থে দুজনের বন্ধুত্বের স্মৃতিচারণ করার পাশাপাশি পাণ্ডুলিপি বাছাই, লেখার জন্য তাগিদ দেয়া, লেখা আদায় না হওয়া পর্যন্ত কীভাবে লেখকের সাথে যোগাযোগ রেখেছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন সে বিষয়ে বলেছেন-

দর্শন নিয়ে আমার একটা বই ছাপতে চান এলিয়ট। ১৯৬২ সালের জানুয়ারিতে ফেবারের সাথে এ নিয়ে চুক্তি সই হয়। এরপর থেকে নাছোড়বান্দা হয়ে আমার সাথে যোগাযোগ রেখেছেন এলিয়ট। লেখার কাজ কতদূর হল জানতে চেয়েছেন, দ্রুত শেষ করার তাগিদ দিয়েছেন। তার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা ছাড়া লিভিং এন্ড নোয়িং বইটির কাজ শেষ করা সম্ভব হত না।

কখনো কবিতার বই থেকে বেশী আয় করতে চান নি এলিয়ট। তিনি বলেছেন, বিশেষ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই থেকে যতটা আয় করা সম্ভব করব। কিন্তু কবিতার বই থেকে কিছুটা লোকসান হতেই পারে। তার মতে কবিতা লেখা কোনো ক্যারিয়ার নয়, এটা একটা খেলা। ফেবার কবিদের প্রতিটি বইয়ের অনুপাতে ১০ভাগ সম্মানী দিয়েছে। এলিয়টের ধারনা আর একটু বেশী দেয়া হলে কবিরা বড়লোক হয়ে যেত। ৪০ বছরের শ্রমে ফেবারকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন এলিয়ট। এখানে কাজ করার সময়টা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এখানেই তারুণ্য পেরিয়ে পা দিয়েছেন মধ্যবয়সে, পৌঁছেছেন বার্ধক্যে। ভেঙেছে সংসার; মৃত্যু হয়েছে স্ত্রীর। জীবনে এসেছে নতুন প্রেম, দ্বিতীয়  স্ত্রী। হয়েছেন এংলিকান চার্চের সদস্য, পেয়েছেন ব্রিটিশ নাগরিকত্ব, নোবেল পুরস্কার। দীর্ঘ চার দশকে কবির জীবনের নানা ঘটনা ও সময়ের সাক্ষী হয়ে থেকেছে এই প্রকাশনা সংস্থা। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কাজ করেছেন এখানে। মৃত্যুর পরও ছিন্ন হয়নি সম্পর্ক। তার স্ত্রী ভালেরিকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। মৃত এলিয়টও ফেবারের কাছে হয়ে ওঠেন বহুল বিক্রীত লেখক। দীর্ঘ সাড়ে দিন দশকে চেয়ারম্যানের পরিবারের একজন হয়ে ওঠেন কবি। নিয়মিত তার হেমস্টেডের বাড়িতে যেতেন।  নিজের বাসায় বাথটাব না থাকায় জিওফ্রি ফেবারের বাসায় গোসল করেছেন। তার পুত্র টমের জন্য জন্য লেখেন শিশুতোষ বেশ কিছু ছড়া। বড় হয়ে টম হয়ে ওঠেন ফেবারের পরিচালক। প্রথমে ছড়াগুলোর নাম রাখা হয় পেলিনেস ডগ এন্ড জেলিনেস ক্যাটস। তার মৃত্যুর পর ওল্ড পোসাম বুক অব প্রাকটিকাল ক্যাট নামে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এন্ড্রু লিও ওয়েভার এসব ছড়াকে সুর দিয়ে শিশুদের উপোযাগী করে মঞ্চায়ন করেন। সারা বিশ্বে ৮ হাজার ৯৪০ বার মঞ্চায়ন হয় এর। ১৮ বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলতে থাকে এর মঞ্চায়ন। এ থেকে অভাবনীয় সম্মানী পান ভালেরি। এই বিক্রি দুর্দিনে টিকে থাকতে সহায়তা করে ফেবারকে। সমবয়সী অন্য প্রকাশনাগুলো যখন লোকসানের কারণে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে নিচ্ছে বা বন্ধ হয়ে গেছে তখন ওল্ড পোসাম বইয়ের মাধ্যমে আবারো ঘুরে দাড়ায় অর্ধ শতাব্দীর বেশী সময় ধরে দাপটের সাথে টিকে থাকা এই প্রকাশনা। এভাবে মৃত্যুর পরও প্রিয় প্রতিষ্ঠানের পাশেই থাকেন এলিয়ট। ফেবারের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সংকলনে এলিয়টের কাজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে জন মুলান বলেন,

একজন লেখক হিসেবেই নয়, ফেবারের পরিচালক হিসেবেও সাহিত্যে আধুনিকতার কাঠামো নির্মাণ করেছেন এলিয়ট। বদলে দিয়েছেন অনেক লেখকের ভাগ্য। নিরহংকারী, মার্জিত, পরিপাটি এই ভদ্রলোক ছিলেন প্রকৃত কবি, উঁচুমানের প্রকাশক। ছিলেন ফেবারের একজন উদ্যমী, পরিশ্রমী পরিচালক। আমি সত্যি বিস্মিত তার অবদানের কথা জেনে। এলিয়টকে ধন্যবাদ, ফেবারের মত ছোট একটা প্রতিষ্ঠানকে তিনি আধুনিক সাহিত্যের পথিকৃত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

এলিয়টের মৃত্যুর ১৮ মাস আগে ফেবারে যোগ দেন ম্যাথিউ ইভান। কবির সাথে তার খুব একটা আলাপ জমে ওঠেনি। শেষ দিকে অসুস্থতার কারণে নিজেকে পেশাগত কাজ থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন, মাঝে মাঝে হাজিরা দিয়েছেন মাত্র। এলিয়টকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধে ম্যাথিউ ইভান জানিয়েছেন কবির সাথে তার দেখা হয়েছে লিফটে। ২৪ রাসেল স্কয়ারের ওপরের তলায় নিজের রুমে যাওয়ার জন্য লিফট ব্যবহার করতেন এলিয়ট। ম্যাথিউ বলেছেন,

প্রথমে আমার মনে হয়েছে তিনি এখানে বসে নিজের কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ লিখেছেন এবং সম্পাদনা করেছেন। লাইব্রেরীতে পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটে আমার ভুল ভাঙে। একজন ভাল প্রকাশকের মত লেখকের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ থেকে শুরু করে সম্পাদনা, বই ছাপা, বিক্রি, বিতরণসহ পুরো প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থেকেছেন এলিয়ট। লেখকের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর, প্রুফ দেখা,  এমনকি প্রচারণার কাজেও অংশ নিয়েছেন। সৃষ্টিশীলতার সাথে তার মাঝে সমন্বয় ঘটেছে তুখোড় ব্যবসায়িক বুদ্ধির। কাজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ এলিয়ট কঠোর পরিশ্রম করেছেন। সহকর্মীদের চেয়ে বেশী পাণ্ডুলিপি পড়েছেন। বই নিয়ে অনেক রিপোর্ট এবং ফ্ল্যাপও লিখেছেন। অন্যদের কাছে যা কঠিন বলে মনে হয়েছে, তা তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে ।

ফেবারের সাফল্যের প্রধান কারণ জিওফ্রেরি ফেবারের নেতৃত্বে কিছু দক্ষ, যোগ্য ব্যক্তির পরিশ্রম। বই বাছাই, পাণ্ডুলিপি পাঠ, বইয়ের তালিকা প্রণয়ন থেকে শুরু করে প্রকাশনার সব কাজ তারা করেছেন সর্বোচ্চ মনোযোগ নিয়ে। তবে একদল মেধাবী মানুষ একজোট হলে তাদের মধ্যে কাজের ধরন নিয়ে মতভেদ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। এলিয়টের সাথেও কখনো কখনো দূরত্ব তৈরি হয়েছে চেয়ারম্যানের। ১৯৮১ সালে ম্যাথিউ ইভান ফেবারের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার পর তার হাতে তুলে দেয়া হয় বিশেষ একটা ফাইল। ফাইলে আরো কিছু চিঠির মাঝে চল্লিশের দশকে এলিয়টকে লেখা জিওফ্রেরি ফেবারের একটা চিঠি। সেখানে নিজের প্রকাশনীর বই বিক্রির বাইরে অন্যান্য ভালো বইয়ের প্রচারণার জন্য তাকে পরামর্শ দিয়েছেন এলিয়ট। বলেছেন,

ভাল বই প্রকাশ করা ভাল কাজ। কিন্তু শুধু ফেবারের নামের ওপর নির্ভর না করে, বাছাই করা ভাল বইগুলোকে মানুষের কাছে পরিচিত করে তোলা, এসব বইয়ের প্রচারণাও জরুরী। শুধু বই বিক্রিই একজন দায়বদ্ধ প্রকাশকের লক্ষ হতে পারে না।

এমন পরামর্শে ক্ষেপে যান চেয়ারম্যান। ফিরতি চিঠিতে এলিয়টকে বিনীতভাবে বলেন,

আমি জানি লেখক হিসেবে যথেষ্ট আন্তর্জাতিক পরিচিতি এবং নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মত অর্জন রয়েছে আপনার। তবে দয়া করে ফেবারকে কিভাবে চালাতে হবে সে ভার আমার ওপরই ছেড়ে দেন। প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ফেবারের প্রতি অন্তত কিছুটা সহানুভূতি আমার রয়েছে।

দুটো চিঠিই সেই বিশেষ ফাইলে যত্নে সংরক্ষণ করা হয়েছে। যারাই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পেয়েছেন তাদের পড়তে দেয়া হয়েছে এসব চিঠি। যেন তারা জানতে পারেন ফেবারের পথ চলার ধারাবাহিকতা, বুঝতে পারেন মতভেদ উপক্ষো করে পরিচালকরা কিভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন ইংল্যান্ডের সেরা এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে। ষাটের দশকের শুরুতে আরো একবার দূরত্ব তৈরি হয় চেয়ারম্যানের সাথে। ১৯৬১ সালে জিওফ্রিকে লেখা এক আবেগপূর্ণ চিঠিতে এলিয়ট বলেছেন, একথা ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে তার মত একজন প্রথম শ্রেণীর লেখক ১৯২৫ সালে ব্যাংকের নিরাপদ চাকরি ছেড়ে তার নতুন প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকিপূর্ণ নিয়োগের ডাকে সারা দিয়েছিল সাতপাঁচ না ভেবেই। যা তার জীবন বদলে দিয়েছে। এলিয়ট আহত হয়েছেন চেয়ারম্যানের একটি মন্তব্যে। এ এল রউসিকে ফেবার বলেছেন, কবিতার জন্য তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন এলিয়টকে। এই মন্তব্যে আহত এলিয়টের আত্মসম্মান, অভিমানকে সমর্থন করেও বলা যায়, প্রায় চার দশকে ফেবার হয়ে উঠেছে টি এস এলিয়টের পরিবার। দু:সময়ে পাশে পেয়েছেন সহকর্মীদের। ফেবারে যোগ দেয়ার পরের ক বছর ব্যক্তিগত জীবনের সংকটের বছর। স্বামীর খোজে বারবার তার অফিসে এসেছেন ভিভিয়েন। কবির নির্দেশনা মেনে সেক্রেটারি তার সঙ্গে দেখা করতে দেননি ভিভিয়েনকে। লুকিয়ে পেছনের গেট দিয়ে এলিয়ট অফিসের বাইরে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত  নানা বাহানায় তার স্ত্রীকে বসিয়ে রেখেছেন অভ্যর্থনা কক্ষে।