মা বৃক্ষের বিয়ে – শিপা সুলতানা

একটা জাড়া পাড়িয়া আনো, পারবায়নি?

রান্নাঘরের দরজা খুলে বাইরে এলাম। পেছনের উঠানে কোনো লাইট নেই। সামনের উঠানের বাগানের কোনায় ৬০ ওয়াটের একটি বাল্ব জ্বলছে। আধো আধো কোয়াশায় সেই আলো ৩০ ওয়াটের মনে হয়। তার থেকে ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে যে আলো আসছে পেছনের উঠানে, দুইহাত দূরে যদি এখন একটা মেছু বাঘ বসে থাকে, বুঝার উপায় নেই। শীতের সময় প্রায় বাড়িতেই উঠানের বাল্ব বদলানো হয়, আমাদের বাড়িতে সেটা সম্ভবই না। বিদ্যুতের বিল নাকী বেশি আসে। পেছনে দিয়ে হাতি গেলে টের পান না কিন্তু সামনে দিয়ে মশা মাছি গেছে তো ঝামেলা আছে আব্বার। আমি চোখ বড় বড় করে অন্ধকার কেটে লেবু ঝাড়ের দিকে হাঁটতে লাগলাম।

আমার ছোট বোনকে কনে দেখতে আসছে। রাতে কেউ কনে দেখতে আসে না। বরের খুব তাগদা, বিয়ে হলে হবে, না হলে তার বিলেতে ফেরত যাবার সময় হয়ে গেছে। ওখানের নামকরা একটি ব্যাংকে চাকরি করে ছেলে। এমন ঘরে বিয়ে হলে বাকী আত্মীয়দের মুখে ঝামা ঘষা যাবে। আমাদের আত্মীয়দের কারোর জামাই ই বিলেতে এমন চাকরি করে না। আমাকে রেখে যেহেতু ছোট বোনের বিয়ের আলাপ চলছে আজকাল, তেমন বাঁধাও আসছেনা। কিন্তু যেই প্রচার হবে বর বিলেতের ব্যাংকে অফিসার, এমনি জ্ঞাতি গুষ্টি খড়গ হাতে হাজির হবে আমাদের বাড়ি। বড় বোনকে রেখে ছোট বোনের বিয়ে হলে কি কি কুফল আসতে পারে আমার, আমাদের ঘরে এবং পুরো বংশে, তা আমাদের সহজ সরল বাবাকে কবুল করিয়ে তবেই হাল ছাড়বে তারা। তাই যত দেরিতে প্রচার, তত মঙ্গল। এই আশায় বরকে রাতে আসতে বলা।

ঘরের লেপ বালিশে পর্যন্ত রোষ্ট পোলাওয়ের গন্ধ ম ম করছে। সালাদ আছে, তিনচার পদের আচারও কিন্তু জাড়া লেবু ছাড়া পরিবারের অভিজাত্য প্রকাশ সম্ভব না। আম্মা মাংসের বাটির উপর হাতা হাতা বাড়তি তেল ঢালতে লাগলেন ডেকছি থেকে, তখন আমাদের বড়বোন, যার ফুফাত দেবর এই বর, খেয়াল করলো জাড়া পেড়ে আনা হয়নি গাছ থেকে। রান্না যেই রাঁধুক, আম্মা বেড়ে না দিলে কেমন যেন মেহমানদারীর রান্না মনে হয়না। আমি খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আম্মার খাবার বাড়া দেখি, আম্মা বলতে না বলতে আমারো মনে হলো জাড়া লেবু না হলে এই খাবার কোনো খাবারই হবেনা।

গাছ, ও গাছ… তোমার কাছ থাকি একটা লেবু নিমু, বেজার অইয়ো না, বদদোয়া দিও না…

সন্তান সন্ততি নিয়ে রাতের বেলা ঘুমিয়েছে মা। ঘুমের ভেতর থেকে একটা বাচ্চা চুরি করে নিয়ে আসলে মা গাছ কিছু বলতে পারবেনা কিন্তু অভিশাপ দেবে, আর আমার কোনোদিন সন্তান হবেনা…আমি কাঁপা কাঁপা হাতে ঝট করে একটা জাড়া পেড়ে আর পেছনের দিকে তাকাই না। পাতলা করে শিশির পড়েছে পাতা ও লেবুর উপরে। দূরের আলো অল্প করে পড়েছে তার উপর। অন্ধকারে দেখলে মনে হয় পাতা ও ফলে অসংখ্য চোখ, আর চোখ ভরা জল নিয়ে না না করছে ফলগুলো। যেনো ঘুম থেকে পেড়ে না নিয়ে আসি তাদের, লা ইলা হা ইল্লা আন্তা, সুবহানাকা ইন্নি কুনতুম মিনাজ্জয়াল্লিমিন… বুকে ফুঁ দেই তিনবার।

বরের খুব তাগদা ছিলো, রাতের খাবার পর পর আকদ হয়ে গেলো, শেষরাতে বউ নিয়ে ফিরে গেলো তারা। যদিও আমার দাদী শুরু থেকে কুনকুন করে কাঁদছিলেন। খাবারের প্রথম লুকমা আমার মুখে না দিয়ে খাবার মুখে তুলেন না তিনি, এমনকি ভরা মজলিশ কি বিয়ে বাড়িতেও। আজ না খেয়েই বিছানায় চলে গেলেন। আকদের পরে সবাই খেতে বসলে দাদীকে ডাকতে গেলাম, খেতে তো এলেনই না, বললেন তুই মরছ না কেনে কপালপুড়ি…ধুর, কয়দিন পর পর বুড়ির এক অভিশাপ। আমি জানি, আপনজনদের অভিশাপ মানে দোয়া। আমিও তার মতো মুখ ঝামটে বললাম ‘ তুমি মরো না কেনে বুড়ি…’। তারপর কনের ঘরের দিকে চলে গেলাম।

নাই নাই করেও ঘরভর্তি আত্মীয় কুটুমে। ফোন পেয়েই দুই ফুফু চলে আসছেন। কারো বিয়ে হলে বড় ফুফু খুব সুন্দর একজোড়া দুল পরেন কানে, আমি তখন তারে কাছে ঘেঁষে ঘেঁষে থাকি, দুল নাড়িয়ে দেই, ফুফু তখন বলেন আমার বিয়েতে এই দুল জোড়া দিয়ে দেবেন তিনি। আজ আকদের পরে দেখি আমার বোনের কানে সেই দুল ! ছোট ফুফুর মেয়েরা বিলেতে থাকে, ফুফুর একেকদিন একেক শাড়ি, নতুন একটি ভারী শাড়ি পরিয়ে দিয়েছেন বোনকে আর তাতেই আমার ফর্সা বোনকে হুবহু কারিনা কাপুরের মতো লাগছে…আমি তার পাশে বসে হা করে দেখতে লাগলাম, আমার বিয়েতে এই শাড়ির মতো কোনো শাড়ি কি ছোট ফুফু দিতে পারবেন আবার?

ড্রাইভার গিয়ে আমার বড় বোনের বাড়ির সবাইকে তুলে নিয়ে আসছে। ফোন পেয়েই চলে আসছেন মামা মামীরা, খালাদের দুইজন। হতভম্ব বাকী আত্মীয়রা কিছু বলতে না বলতে আকদ হয়ে গেছে বোনের। কেউ কেউ আমার দিকে স্বল্প সময়ের জন্য তাকিয়েছিলো, আমার সুন্দর মেকাপ তাদের যেন সহ্যই হচ্ছিলো না…

মাথা ভরে গেছে উঁকুনে। এ ক’দিন নতুন মেহমানদারী, রান্নার পর রান্না, কারো খেয়ালই ছিলোনা আমার মাথা উঁকুনে ভরে গেছে, আজ অবসর পেয়ে পিড়ি পেতে বসেছেন আম্মা। উঁকুনও আনছেন টপাটপ, হঠাৎ মাথার তালুতে পানির ফোঁটা। বৃষ্টি হচ্ছে নাকী! ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি আম্মা কাঁদছেন। আম্মা প্রায়ই কাঁদেন।

শেষরাতে সবাই যখন উঠানে বেরিয়ে আমার বোনকে বিদায় দিচ্ছিলো, সবার মতো আমিও যাচ্ছিলাম বিদায় দিতে, আম্মা আমাকে ঝাপটে ধরে গগণ বিদারী এক কান্না। আম্মা কি আমার বিয়ের দিনও এমন করে কাঁদবেন!

আম্মা কান্দো কেনে? আঙ্গুল দিয়ে দুই গাল মুছে দেই কিন্তু পানি আর শুকায় না।
‘আম্মায় তুমারে খুব সুন্দর করি বিয়া দিমু, নীনার লাখান রাইত নায়, দিনো বিয়া অইবো আর নীনার জামাই থাকি সুন্দর জামাই অইবো তুমার…’
আমি বললাম নীনার জামাইর মতো, এর চেয়ে সুন্দর বর লাগবেনা।

সেদিন রাতে আকদের পর পর নীনার মতো নীনার জামাইকেও খুব সুন্দর লাগছিলো। বৃষ্টির সময় কলা গাছের শরীর বেয়ে যেমন পানির ধারা নেমে যায়, নীনার জামাই যেনো এমনই সুন্দর আর বৃষ্টির রাতে জোছনা উঠলে যেমন আশপাশ চকমক চকমক করতে থাকে, নীনার আলো তার জামাইর উপর পড়ে এমনই চকমক চকমক করছিলো, তখন বড় আপা আমাকে হ্যাচকা টান দিয়ে অন্য ঘরে নিয়ে গেলে বাজুর ব্যাথায় আমি উফ্ করে উঠি।

গাছ, ও গাছ…দুইটা বরই পাড়িয়া নেই? বেজার অইয়ো না…মাফ করি দিও…

আমাদের বড় বোনের খুব বড় একটি পেট হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম সে যে রাক্ষসের মত ভাত খায় এই জন্য এতো বড় পেট, পরে যখন সবার মুখ কালো হয়ে গেলো, বুঝলাম বড় আপার পেটে বাবু আছে। বাবুর আগেই তার বিলেতের ভিসা হওয়া দরকার, না হলে পরে ঝামেলা হবে। নীনাই চলে যাবে তার আগে, বড় আপাই রেগে রেগে বললো আমাকে সে কথা। বড় আপা সমানে খাচ্ছে, আজে বাজে কিছুই বাকি নেই যা সে খাচ্ছেনা। এখন এশার আজান পড়ছে, সে আমাকে গাল টিপে বললো যা লীনা, আপার লাগি দুইটা বরই পাড়িয়া আন।

গাছ ও গাছ, আরো দুইটা বরই নেই? বেজার অইয়ো না…আমারে বদদোয়া দিও না…

আপা বরই খেতে না খেতে আম্মার মনে হয়েছে কালিয়ারা মাছে বরইর টেঙ্গা রাঁধবেন। বড় আপা মাছ খেতে পারেনা গন্ধে, টেঙ্গা হলে তার সুরুয়া দিয়ে দুটি ভাত খাবে। এদিকে ভাইয়েরা এখনো বাড়ি ফিরেনি, আব্বা নামাজে।আমি বাঁশের কুটা দিয়ে আলতো করে বাড়ি দিয়ে দিয়ে আরো এক কোচড় বরই নিয়ে আসি। আমার খুব বুক কাঁপে। দাদী পই পই করে বলেন রাতের বেলা গাছ থেকে পাতাটাও না পাড়তে, গাছ বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ঘুমায়, এ সময় কেউ তার বাচ্চাদের গায়ে হাত দিলে অভিশাপ লাগে। তার আর হুরুতা অয় না গো বইন…

বাবুকে পেটে নিয়েই বড় আপা বিলেতে চলে গেছে, বাবুর যে দিন জন্ম হলো, তার এক সপ্তাহ পরে চলে গেছে নীনাও। আমার তখনো কোনো বিয়ের আলাপ আসছেনা। আসছে না নয়, আব্বা আম্মার পছন্দ হচ্ছেনা। সেদিন হাতের লাঠি নিয়ে তেড়ে গেলেন দাদীও। এমন করলে কারো বিয়ে হয়!

কেমন দূর দূর থেকে বিয়ের আলাপ আসে। বাবা মা’র কী, আমার নিজেরই ভাল লাগেনা। আমি বলেছি বড় দুলাভাইয়ের মতো অথবা নীনার জামাইর মতো বর চাই আমার, এ কথা বলতে না বলতে ঠাস করে একটা চড় খেলাম আম্মার হাতে। এমন চড় আমি হর হামেশা খাই, আজ রাগ উঠে গেলো, বললাম ওদের জামাইর মতো বর না হলে আমার বাবুরা সুন্দর হবেনা, আমার সুন্দর সুন্দর বাবু চাই…তখন লম্বা চুলের বেনী ধরে টান দিয়ে আম্মা তার কাছে টেনে নিলেন তার পর ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত মারতে থাকলেন। দাদী কাছে থাকলে ছাড়িয়ে নিতেন কিন্তু আব্বা আমাকে ছাড়িয়ে না নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

আমার বড় ভাইয়ের বিয়ে হবে হবে, কিন্তু কনের বাড়ি থেকে তাগদা আসছে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে। আমি কান খাড়া করে শুনি শরীফ ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে হবে। আমাদের আপন চাচাত ভাই, দুই জন ভাবী তাকে ছেড়ে গেছে বিয়ের তিন চার বছর পর পর। সবাই বলে শরীফ ভাইয়ের কোনো বাবু হবে না। তার সাথে আমার বিয়ে! ঝট করে বাবা মা’র ঘরে গিয়ে হুলস্থুল বাঁধিয়ে দিতে চাইছিলাম কিন্তু আম্মার হাতে মার খেলে আমার সব মেকাপ এলোমেলো হয়ে যায়।

আমি কিছুই বললাম না। আমাদের গ্রাম ভর্তি টিলা টালায়। কোথাও লুকিয়ে থাকলে কেউ আমাকে খুঁজে পাবেনা। শরীফ ভাইকে বিয়ে করলে আমার বাবু হবেনা। সবার উপর খুব রাগ হলো। রাত হলেই সবার বরই, নাগা মরিচ, লেবু, জলপাই খাবার কথা মনে পড়ে, আর সেটা আমাকেই পাড়তে পাঠায় গাছেদের কাছে। গাছেদের খুব অভিশাপ লেগেছে। আমি নি:শব্দে পেছনের উঠানের দরজা খুললাম।

ও গাছ… আমার উপরে বেজার অইছে নি! আমারে মাফ করিয়া দিও…

সব গুলো গাছের কাছে চুপি চুপি ক্ষমা চাইলাম। তারপর হাঁটতে লাগলাম গভীর বনের দিকে…