বাবুল মোরা নৈহার ছুটো হি যায়ে (O My father! I’m leaving home)  – দেবাশীষ মজুমদার

‘আমার নিজেকে ছেলে ভাবতে ভাল লাগতো, আবার সেই আমিই সেসময় পুতুল নিয়ে খেলতে ভাল বাসতাম, পুতুলের বিয়ে দেবার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে যেতাম’  -বারাণসীর ছোট বেলার স্মৃতি নিয়ে কথা বলতে ভালবাসতেন সব সময় গিরিজা দেবী।ঠুমরী গানের এই রাণী ১৯২৯ সালের ৮ ই মে বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর কাছে একবার জানতে চাওয়া হয়েছিল- ‘এই যে আপনার এই বারাণসী সঙ্গীতের ঘরানা, এই ঘরানার একজন শিল্পী হিসেবে আপনার কখনো কি মনে হয়েছে এখন যে শিল্পীরা এই ঘরানা থেকে বেরিয়ে, এই শহর থেকে বেরিয়ে বড় শহরে যেমন মাইগ্রেট করছে, তেমনি তারা জীবিকার জন্য সঙ্গীতকেও বদলাচ্ছে, আপনার কি মনে হয় না এই বদলের রীতি চলতে থাকলে এক সময় সঙ্গীতের মানচিত্র থেকে বারাণসী মুছে যাবে?’এর উত্তরে তিনি যা বলেছিলেন তাতে প্রকাশ পায় কতোটা আধুনিক ছিলেন! – ‘না, এটা কখনই মুছে যাবে না। অন্যান্য অনেক ঘরানার গানকেই ফিউশন, ব্যান্ড বা কাওয়ালীর আদলে উপস্থাপন করা হয়েছে ইতোমধ্যে । আজকাল মানুষ অনেক ব্যস্ত। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শুনবার জন্য ঘণ্টা’র পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করবার আগ্রহ এখন আর তাদের মধ্যে নেই। সারা বিশ্বেই শিল্পীরা এখন জীবিকার জন্য সঙ্গীতে নানান মিশ্রণ আনছে। কিন্তু, আপনি আমাকে বলুন কোথায়, কীসে আর আপনি সেই খাদহীন ব্যাপার পাচ্ছেন? এমনকি খাবার দাবারেও ফিউশন ঢুকে পড়েছে! আজকাল সব জায়গাতেই মানুষ তাদের পুরনো রীতি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কিছু করতে চাইছে, আর এতে আমার কোন আপত্তি নেই। যাই হোক, শিল্পী হিসেবে আমি কখনোই আমার গায়কীতে কিছু মেশাইনি, এটাই আমার পরিচয়’।

তাঁর জমিদার বাবা তাঁকে সাঁতার, ঘোড়দৌড় এমনকি লাঠিখেলায়ও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি সেসব ভালবাসতেনও। কিন্তু পড়াশোনায় কখনোই খুব একটা আগ্রহ পাননি। গায়ক এবং সারেঙ্গী বাদক সরযু প্রসাদ মিশ্রের কাছে তাঁর সঙ্গীতে হাতে খড়ি। তখন বয়স ছিল পাঁচ। খুব অল্প বয়সেই খেয়াল, ধ্রুপদ, ধামাল, তারানা, ভারতীয় লোকগীতি এবং ভজন শিখে ফেলেন। সে সময় বারাণসী হিন্দু এবং মুসলিম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকারদের কেন্দ্র ছিল। এই যুগল সান্নিধ্য তাঁকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। ১৯৪৯ সালে তাঁর গান প্রথম এলাহাবাদ রেডিওতে প্রচারিত হয়।

ঐ সময় কোন অডিশন সিস্টেম কিংবা শিল্পীদের গ্রেডের প্রচলন ছিল না, কিন্তু তাঁকে মায়েস্ত্রো বিসমিল্লাহ খাঁ, সিদ্ধেশ্বরী দেবী কিংবা কান্তি মহারাজের মতন সমান সম্মানী সেই বিশ বছর বয়সে দেয়া হয়েছিল, এটা তাঁকে ভীষণ উদ্বেলিত করেছিল। এর দু’বছর পরেই প্রথমবারের মতো বিহারে জনসমক্ষে গান করেন। ১৯৫২ সালে কলকাতায় আসেন এবং পরবর্তীতে এই শহরেই থেকে যান তিনি। বিরল কিছু বন্দিশের ধারক হিসেবে তাঁকে সব সময় স্মরণ করতে হবে। এত বিখ্যাত শাস্ত্রীয় শিল্পী হয়েও কেন সিনেমায় গান করেননি এ ব্যাপারে একবার জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁর কাছে। উত্তরে বলেছিলেন–

‘আমার তরুণ বয়সে আমি উস্তাদ আমির খাঁ সাহেব এবং ডিভি পালুস্কার জী’র সঙ্গে ট্যুর করেছি, সেই সময় খাঁ সাহেব বাইজু বাওয়ারা নামের একটা সিনেমায় গান গেয়েছিলেন। তো তখন সেসব ট্যুরে দুর্দান্ত ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত পরিবেশনের পরেও শ্রোতারা তাঁকে ক্রমাগত সেই সিনেমার গান করতে অনুরোধ করতো। সেই একই ব্যাপার দেখেছি উস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁর ক্ষেত্রেও।  দারুণ সব ক্লাসিক্যাল পারফর্মেন্সের মধ্যেই লোকে তাঁকে গুঞ্জ উঠি সেহনাই পরিবেশন করতে অনুরোধ করতেন। তারা এতে কষ্ট পেতেন। এটাই আসলে আমার মধ্যে এক ধরনের বোধ তৈরি করে দিয়েছিল। তখন অবাক হয়ে ভাবতাম, কী করে কেউ একটা সম্পূর্ণ ক্লাসিক্যাল পারফর্মেন্সের পরেই চার পাঁচ মিনিটের গান শুনতে চাইতে পারে! আমার কাছে এটাকে খুব অসম্মানজনক মনে হত। তখনতো সিনেমার টিকেট ৫ টাকায় বিক্রি হত, তো কেন একটা টিকেট কিনে সেই গানগুলো শুনে আসছোনা? সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সাথে কেন সিনেমার গান মেলাচ্ছ? এটাই আসলে আমায় সিনেমার গান থেকে দূরে রেখেছে’।

ছয় দশকেরও বেশি বর্ণাঢ্য সংগীত জীবনে এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পী অর্জন করেছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা।  যার মধ্যে রয়েছে পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ, পদ্মশ্রী, সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার এবং সংগীত নাটক আকাদেমি ফেলোশিপ। পৃথিবীর সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দিয়েছে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধি। তাঁর জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র গিরিজা। গত ২৪শে অক্টোবর রাত ন’টা নাগাদ সময়ে ৮৮ বছর বয়সে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন।

তাঁর ৮০তম জন্মদিনের আগেই বলেছিলেন,

‘আমি যদি খেতে পারি, কথা বলতে পারি, হাঁটতে পারি তবে কেন গান গাইতে পারব না?’