লেখকের জাদুবাস্তববাদ ও জাদুবাস্তববাদী লেখক – হামীম কামরুল হক
লেখকের জাদুবাস্তববাদ ও জাদুবাস্তববাদী লেখক নিয়ে আমাদের ‘কী করবার’ ও ‘কী কারবার’- সেকথায় যাওয়ার আগে আমার ‘লেখক কে’ ও ‘লেখা কী’- সেদিকে একটু নজর বুলিয়ে আসি। কারণ বহু বার বলা হলেও হয়তো এটি পুরানো হয়ে যায় না। লেখা নিয়ে নানান তর্ক চলে, এটি ‘এই-লেখা’, ওটি ‘ওই-রকম’- শ্লীল-অশ্লীল বিবেচনাও আছে- নানান বিবেচনায় লেখাকে বাতিল খারিজ করেও দেওয়ার চল আছে। কিন্তু সেটি আসলে ‘লেখা’ কিনা তা-ই আদতে বুঝে নেওয়ার দরকার। একইভাবে ‘তিনি এই রকম লেখক’ বা ‘ওই রকম লেখক’, বা ‘ওই পন্থী লেখক’- এসব তকমা ছাপ্পা দেওয়ার চল হরদম। কিন্তু তিনি আসলে ‘লেখক কিনা’- সেটাই আগের ও সবশেষের বিবেচনা বলেই বোধ হয়। সেদিক থেকেই আসলে লেখকের জাদুবাস্তববাদ তাকে জাদুবাস্তববাদী লেখক করে তোলে কি তোলে না- সেদিকে যাওয়া যেতে পারে। তবে সবার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক, যে লেখক কাকে বলা হয়। প্রাচীনরা এ ব্যাপারে কী বলেছেন।
চাণক্য শ্লোকে ‘লেখক’ সম্পর্কে বলা হয়েছে-
সকৃদুক্তগৃহীতার্থো লঘুহস্তো জিতাক্ষরঃ।
সর্বশাস্ত্রসমালোকী প্রকৃষ্টো লেখকঃ স্মৃতঃ॥
অর্থ হচ্ছে: ‘‘একবার বলামাত্র যিনি অর্থ বুঝতে পারেন, যিনি দ্রুত লিখতে পারেন, যার হাতের লেখা সুন্দর এবং যিনি সকল শাস্ত্রে অভিজ্ঞ- তাকেই উত্তম লেখক মন করবেন।’’ খেয়াল করতে হবে, তখন লেখা অনেকটাই একজন বলতো আরেক জল লিপিবদ্ধ করত, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারতে কাহিনি বলছেন আর গণেশ তা লিপিবদ্ধ করছেন- এই দৃশ্যটা নিশ্চয়ই কারো কারো মনে জেগে উঠতে পারে। কারণ সেখান শর্তই ছিল এমন যে, একবার বলামাত্র শুনে তা লিপিবদ্ধ করার যোগ্যতা থাকতে হবে লেখকের।
এখান থেকে যারা নিজেকে লেখক হিসেবে মনে করেন, তারা আসলে কতটুকু লেখক সেটি বুঝে নিতে পারেন, তবে একালের বিবেচনাটা যোগ করে। কারণ এর প্রত্যেকটি যে মিলবে তা নয়। লেখার সৃষ্টি হওয়া বা লেখক হওয়ার বিষয়টি পূর্বনির্ধারিত ছক মেনে হয় না। তবে লক্ষণ তো থাকেই, কিছু বৈশিষ্ট্য টের পাওয়া যায়, এই যা।
অনেকেই বলেন, তিনি লিখতে না পেরে থাকতে পারেন না, বলেই লেখেন, কেউ বলেন, কথাটা না লিখে থাকা না-থাকার ব্যাপার না, লিখতে পারেন বলেই আসলে কেউ লেখেন।
সভ্যতার শুরু থেকে মানুষের এই-যে লেখালেখি, তার পেছনে মূল কারণটা কী? সমাজের কল্যাণ? সৌন্দর্য সৃষ্টি? অমরত্ব? একালে কিছু ‘অলেখক/অপলেখকে’র কেবল যশ-খ্যাতি-প্রচার-অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা-প্রতিপত্তি অর্জনের জন্যই লেখা? নাকি কেবল কিছু একটিতে নিজেকে যুক্ত বা জড়িয়ে রেখে জীবনটাকে যাপন করা মাত্র- এই নিয়ে নানান জনে নানা কথা বলবেন। এই যে আমার কথাটা শুনি-
Want to live a thousand lives? You must read books. Want to live forever? Write.
(সহস্র জীবন যাপন করতে চাও? তাহলে বই পড়। চিরকাল বেঁচে থাকতে চাও? তাহলে লেখ।) লেখার ভেতরে দিয়েও তো হাজার জীবন যাপন করা যায়। কিন্তু পড়ার ভেতর দিয়ে হাজার জীবনযাপনের নিশ্চয়তা যতটুকু, লেখার ভেতর দিয়ে চিরকাল বেঁচে থাকার ব্যাপারটা ততটা নিশ্চয়তা দেয় না। কারণ এতে লেখার মান বিবেচনা, সেই লেখা কতটা চিরদিনের পাঠযোগ্য, সেটা বিবেচনার অবকাশ থাকে। (আর এক জীবনে সহস্র জীবন যাপন করা ও মৃত্যুর পরও অমর থাকা জাদু-ই তো? কিন্তু তা কি জাদুবাস্তববাদ?) আমরা জানি, সত্যিকারের সাহিত্যে সবসময়, সব জায়গায় নতুন থাকে। সেটি বেদব্যাস বা হোমারের মহাকাব্য হোক বা সংস্কৃতে নারায়ণের রচিত ‘হিতোপদেশ’ বা গ্রীকে ইশপ কি ফরাসীতে জাঁ দ্য লা ফঁতেন-এর নীতিকথা হোক, সেটি দেশ-কাল-জাতি-জনগোষ্ঠী নির্বিবেশে পঠিত হয়ে চলে।
আমরা জানি, কোনো লেখকের লেখাকে বা কাজকে ‘ওয়ার্কস’ বলা হয়, যেমন ‘কমপ্লিট ওয়ার্কস অব উইলিয়াম শেক্সপিয়র’, ‘কমপ্লিট ওয়ার্কস অব অ্যাডগার অ্যালান পো’ ইত্যাদি। লেখা তেমনই একটি কাজ। আর কাজ বলতে আমরা যেটা জীবিকা বুঝি, চাকরি-বাকরি বুঝি সেটা যতটা কাজ এর চেয়ে তাকেই ‘কাজ’ বলি যেটির টিকে থাকবার ক্ষমতা আছে, যেটি ‘সাস্টেইন’ করে। ফলে টেকশই লেখাকে জুৎসই তকমা দিলে সেটি আলাদা মাত্র পায়, ঠিকই, কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা, তা চিরকালের হলে তা কীসের তকমা পেল না পেল তাতে খুব একটা ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না।
জাদুবাস্তববাদ ষাট-সত্তর থেকে লেখায় যেভাবে জোরালো হয়ে উঠল, সেটি বোধ হয়, সবাই মানেন যে তা জোরালো মাত্রা পেয়েছিল লাতিন আমেরিকার লেখকদের হাতেই। এখন কার লেখায় সেটি প্রথম দেখা দিয়েছিল? আলেহো কার্পেন্তিয়ের নাকি বোর্হেস-এর? আর্তুর উস্লার-পায়েত্রি বা হুয়ান রুলফো-র? এসব নিয়ে কথা-কড়াকাড়ি চলতেই পারে। আমাদের দেখা দরকার জাদুবাস্তববাদ, যা কিনা চিত্রসমালোচক ফ্রাৎনস রোহ হাতে প্রথম, ১৯২৫ সালে, তকমা পেয়ে গার্সিয়া মার্কেসে এসে পরিপূর্ণতা পেল, এর আসলে কোন চেহারায় দাঁড়িয়েছে, সেটি একটু দেখে নেওয়া।
জাদুবাস্তবাবাদের শুরুটা চিত্রকলা দিয়ে হলেও এর মূল আধার কিন্তু এখন সাহিত্যই। পরে যতই ‘জাদুবাস্তববাদী চলচ্চিত্র’ ইত্যাদি বলা হোক, কথাসাহিত্য মানে গল্প-উপন্যাস, বিশেষ করে উপন্যাসের ভেতর দিয়েই এটি প্রচার ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অনেকে কবিতায় জাদুবাস্তববাদ খুঁজতে যান ও সেটি পানও নাকি!- এতে সেটিকে আরোপিত বলেই মনে হয়। সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্বসাহিত্যের কোনো বড় কবিকেই জাদুবাস্তববাদী বলে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হতে পারে, কবিতা প্রতীকবাদ থেকে চিত্রকল্পবাদ কি পরবাস্তববাদ হয়ে যে যে মাত্রা পেয়েছে, সেখানে জাদুবাস্তববাদ আলাদা করে জায়গা করার বিষয় নয়। কবিতা নিজেই জাদু। জাদুবাস্তববাদতে তার দরকার নেই বললেই চলে। ‘নামছে জোছনা/ যেন তরবারি/ সেই তলোয়ারে আঘাতের পর আঘাত/ নির্জন প্রেমার্ত রাত্রিতে প্রেমিকের করোটি ভেদ করে যাচ্ছে কোথায়? হৃদয়সমুদ্র তখনও আশ্চর্যরকমের নিঝুম, নিস্তরঙ্গ।’- এটাকে চিত্রকল্পবাদে না জাদুবাস্তববাদের ফেলবেন, বলা একটু মুশকিল, নয় কি? বিখ্যাত কয়েকজন জাপানি লেখক কোব আবে, কেনজাবুরে ওয়ে, হারুকি মুরাকামি থেকে শুরু করে আমাদের কাছে প্রায় অপরিচিত রোমানিয়ার লেখক আয়ন ভানিয়া-কেও জাদুবাস্তববাদী লেখকের কাতারে সাজানো হয়েছে। মূলত সাজানো হয়েছে তাঁদের কিছু কিছু লক্ষণ বিচার করে। এজন্য, মজার ব্যাপার রুশ সাহিত্যের দিকপালদের একজন নিকোলাই গোগল এবং রুশ বিপ্লব পরবর্তী সবচেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী লেখকদের একজন মিখাইল বুলগাকভ-কেও রাখা হয়েছে এই তালিকায়। যে বুলগাকভের মৃত্যু হয়েছে ১০ মার্চ ১৯৪০ সালে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে। ঠিক তার পাঁচ বছর আগে, কারো কারো মতে বোর্হেসের ‘ইউনিভার্সেল হিস্ট্রি অব ইনফেমি’ (১৯৩৫) তে জাদুবাস্তববাদ প্রকটিত হয়, আবার কারো মতে সত্যিকারের জাদুবাস্তববাদ এল কার্পেন্তিয়ের-এর ‘দ্যা কিংডাম অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’ উপন্যাসে, ১৯৪৯ সালে। ফলে যে-গোগল মরে ভূত হয়ে গেছেন, জাদুবাস্তববাদ নামের জিনিস সাহিত্যে শনাক্ত করার বহু আগে, ১৮৫২ সালে, তাকেও জাদুবাস্তববাদী লেখকের ছাপ্পা দেওয়া হচ্ছে, তেমন দেওয়া হচ্ছে সমকালের বিশ্ববিশ্রুত লেখক হারুকি মুরাকামিকে।
এর কোনোটাই হতো না জাদুবাস্তববাদ বিষয়টি স্পষ্ট করে জানা থাকলে। (বর্তমান প্রবন্ধ লেখক তাঁর ‘জাদুবাস্তববাদ’ গ্রন্থে সেটি স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন) এটি সত্যিই একটি বক্তব্য বা অভিব্যক্ত প্রকাশের ভিন্ন একটি পথ, যেটা দেখতে জাদুময় মনে হবে, কিন্তু তাতে মূলত দগদগ করবে একটি প্রবল বাস্তববাদী ঘটনা। এর কারণেরই ফ্রানৎস কাফকা থেকে হোসে সারামাগোর লেখায় যেভাবে বিষয়কে উপস্থাপন করা হয়, তার পেছনে থাকে প্রখর এক বাস্তববাদী বোধ। ফলে কোনো এক মানুষের রাতারাতি পোকা হয়ে যাওয়া (দ্যা মেটামরফসিস) বা হঠাৎ করে একটি শহরে একের পর এক লোকের অন্ধ হতে শুরু করা (ব্লাইন্ডনেস) বা একদিন দেখা গেল একটি শহরে আর কেউ মৃত্যুবরণ করছে না (ডেথ অ্যাট ইন্টারভেলস)-এদের ভেতরে জাদু না বাস্তববাদের উলটা দিক মানে অবাস্তবতা, উদ্ভটত্ব প্রধান- সেটি নিয়ে ধুম যুক্তি ও পালটা যুক্তি দেওয়া যেতে পারে। আমরা আমাদের সময়ের কাছাকাছি, এই সময়ের বিশ্বসাহিত্যের প্রধান কয়েকজন ঔপন্যাসিক, তাদের সবাইকে জাদুবাস্তববাদী লেখক হিসেবে তকমা দিতে দেখি, যেমন- গুন্টার গ্রাস, গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, মিলান কুন্দেরা, ইতালো কালভিনো, হোসে সারামাগো এবং সালমান রুশদি। এবং সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (খোয়াবনামা উপন্যাসের বদৌলতে) এবং শহীদুল জহিরের তাঁর প্রায় সমস্ত সাহিত্যকীর্তির কারণে জাদুবাস্তববাদের ধারক হিসেবে চিহ্নিত করি। সৈয়দ শামসুল হকের কিছু লেখার কারণে তাঁর নামটি উচ্চারিত হতেও পারত, কিন্তু হয় না। লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তবাবাদ বলতে যা বোঝায় সেই ধারার কিছু আভাসমাত্র তাঁদের লেখায় গেছে, সার্বিকভাবে জাদুবাস্তববাদী লেখা বাংলায় নেই বললেই চলে।
জাদুবাস্তববাদী লেখক কারা নন? গোগলকে যেহেতু বলা হয়েছে জাদুবাস্তববাদী লক্ষণের দিক থেকে, তাহলে তুর্গেনেভ, দস্তয়েভস্কি, তলস্তয়, চেখভ, গোর্কি, শলোখভ-এঁরা জাদুবাস্তববাদী নন। জাদুবাস্তববাদী নন, ডিকেন্স, থ্যাকারে থেকে শুরু করে ডি.এইচ লরেন্স, জেমস জয়েস, ভার্জিনিয়া উলফ। মার্কিন সাহিত্যের ফকনার, টমাস উলফ, হেমিংওয়ে, জন স্টেনইব্যাক থেকে শুরু করে ডেনাল্ড বার্থেলেমে, ফিলিপ রথ, টমাস পিনশেন, ডন ডিলেল্লো প্রমুখ নন জাদুবাস্তববাদী লেখক। উমবার্তো একো বা ওরহান পামুক-ও তা নন।
বাংলা সাহিত্যে আর যাদেরই জাদুবাস্তববাদী বলা হোক না কেন- হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক, কায়েস আহমেদ প্রমুখের লেখাকে এর আওতার বাইরে রাখা হবে বলেই বোধ করি।
অমিয়ভূষণ মজুমদারের সূত্রে পাওয়া সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘কে যেন বলেছিলেন গল্পের গরু গাছে উঠতে পারে। তা হয়তো পারে কিন্তু সে গল্প উপন্যাস নয়, কারণ উপন্যাসে তাদের ঘাস খেতে হয় মুখ নিচু করে এবং মাঠে। রাবণের দশ মাথা নিয়ে কাব্যে কোনো নালিশ নেই, আর সেখানে আমরা তা বিশ্বাসও করি, কিন্তু উপন্যাসে যদি বা সে তেমন আসতে চায়ই তবে তাকে বলে নিতে হবে একটা বেশি তাঁর কাঁধে যা আছে তা মুখোশ।’
এখন তাহলে জাদুবাস্তববাদের রেহাই কোথায়? সেটি হল, জাদুবাস্তববাদ এই ধারণাটিকেই নস্যাৎ করে তৈরি হয়। জাদুবাস্তববাদী গল্প তো বটেই উপন্যাসের গরু কেবল ঘাস খায় না, আকাশে উড়ে বেড়াতে পারে, আর মানুষের দশটা মাথা, কুড়িটা লেজ গজাতে পারে। – কিন্তু, হ্যাঁ, একটি ‘কিন্তু’ আছে, সেটি হল, কীভাবে এই গরুকে আকাশে ওড়ানো হবে, আর দশমাথা কুড়ি লেজওয়ালা মানুষকে হাজির করা হবে- সেটি হয়ে ওঠে জাদুবাস্তববাদী লেখকের চ্যালেঞ্জ। একটি বিশেষ পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করার ভেতর দিয়েই হয়তো তিনি তা করতে পারেন, কিন্তু হুটহাট করে এসব হাজির করলে, তা হলে সেই উদ্ভট আজগুবির নামান্তর হয়। সেখান থেকেই লেখকের হাতে জাদু বা জাদুবাস্তবতার উপাদান জাদুবাস্তববাদ হয়ে দেখা দিতে পারে। মার্কেসের ‘সরলা এরেন্দিরা ও তার নিঠুর দাদিমা’ গল্পে উলেসেসের হাতের স্পর্শে স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাস রঙিন হয়ে তার মনে জেগে ওঠা প্রেমেকে যেভাবে দেখায়, সেই মাত্রায় জাদুকে বাস্তবতায় নিয়ে আসতে না পারলে তা কেবল অতিপ্রাকৃত, উদ্ভট, রহস্যলীলার মধ্যেই আটকে থাকে। তবে গ্রাসের মতো পুরো উপন্যাস জুড়ে একটি বামনের বিদ্যামনতার যে-জাদু (দ্যা টিন ড্রাম) বা সারামাগোর উপন্যাসে শহর জুড়ে অন্ধত্বের মহামারির যে-জাদু (ব্লাইন্ডনেস)) সেটা তৈরির পেছনে আসলে জাদুবাস্তববাদের চেয়ে তাদের নিজস্ব আইডিয়া/ ধারণা/কনসেপ্ট-ই কাজ করেছে বলে বোধ করি। লাতিন আমেরিকার সংস্কৃতির ভেতর থেকে উঠে আসা ভাষা ও সাহিত্যের সেই জাদুবাস্তববাদের চেয়ে এটি ভিন্ন। অমিয়ভূষণ লাতিন আমেরিকার ম্যাজিক রিয়ালিজমকে সেখানকার কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন লেখকদের বিশেষ উদ্ভাবন বলেই মনে করেন। মোদ্দা কথায়, তাদের
জাদুবাস্তববাদ প্রতিবাদেরই একটি রূপ মাত্র।
এমনিতে জাদুর উৎপত্তির দিকে তাকালে তো এই সত্যের মুখোমুখি হতেই হয় যে, বিরুদ্ধ শক্তিকে প্রতিরোধের কারণেই এই জাদুবিশ্বাস। পরে পরে এটাই সংগীত, সাহিত্য, বিজ্ঞান সব কিছুর উৎপত্তির মূলে কাজ করেছে, যার প্রধান দিক হলো- ‘তোমাকে বশীভূত করে, জয় করে, আমি আমার অস্তিত্ব ঘোষণা করছি।’ বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সেই অস্তিত্বের ঘোষণা রবীন্দ্রনাথের পর বহু বিচিত্রভাবে হলেও আমরা বিশ্বের দিকে নিয়ে যেতে পারিনি। এর জন্য আমাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতাটা বিশেষভাবে দায়ী বলেও বিদগ্ধজনেরা মনে করেন। নব্য ঔপনিবেশবাদের বিরোধিতায় আমাদের কেবল মনে রাখা দরকার যে, আমাদের নিজেদের ভেতর থেকে মুক্ত হতে হবে এবং বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে, এবং সেটি দাস্যভাবে বা দাস হয়ে নয়, প্রভু হয়েও নয়; জ্ঞান-প্রজ্ঞায় ভাস্বর একজন সৃজনশীল মানুষ হিসেবেই- আমি একই সঙ্গে আমার দেশের ও বিশ্বের মানুষ হব- সেই মানসিকতায়। নিজেকে বিশ্বের চেয়ে বিচ্ছিন্ন করে কখনো কিছু অর্জন করা সম্ভব নয় এখানে ও এখন।
জাদুবাস্তববাদ আমাদের সাহিত্য সেই ‘মুক্ত করো হে বন্ধ, যুক্ত করো সবার সঙ্গে’-এর একটা উপায় হতে পারে, যেমনটা হয়েছে ইউরোপে, লাতিন আমেরিকায়, সেই ভূমিকায় এর চর্চা আমাদের কাজে আসতে পারে; নইলে তা আমাদের লেখকদের ঘাড়ে ভূত হয়েই চেপে বসবে মাত্র (কারণ পুরানো সেই আশঙ্কা তো থাকেই: ‘পাশ্চাত্যে যা মরে যায়, তাই আমারে প্রাচ্যে ভূত হয়ে চেপে বসে।’)। সেটি হলে এর ভার বহন করা ছাড়া আমাদের এ নিয়ে কিছু করার নেই।#