আট বছর আগের একদিনঃ একটি ভিন্নপাঠ – রোখসানা চৌধুরী

১.

আত্মহত্যা ধর্ম ও রাষ্ট্রপক্ষ উভয়ের দৃষ্টিতেই গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। তাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সর্বদাই ‘আত্মহত্যা’ প্রপঞ্চটির উপর সবিশেষরূপে খড়গহস্ত। প্রমাণস্বরূপ, তারা জীবনানন্দ দাশের আত্মহত্যার ঘটনাটিকে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থাকা সত্ত্বেও অস্বীকার করতে চায়, বিভিন্নভাবে। এমন কি- তার সৃষ্ট ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটির কল্পিত কৃতবিদ্য আত্মহত্যাকারীর ঘটনাতেও সমালোচক গোষ্ঠীর প্রবল আপত্তি পরিলক্ষিত হয় কবিতাসৃষ্টির পর্ব থেকেই।

‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটির ঘোরগ্রস্ততায় আবিষ্ট হবার পূর্বে বরং উপন্যাসের মধ্যবিত্ত মধ্যাঞ্চল থেকে ঘুরে আসা যাক। খুবই লক্ষ্য করার মত আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, তার উপন্যাসের কোনো নায়কই আত্মহত্যা করে না। তারা নিতান্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করে। এই অবয়বটিকে খোদ জীবনানন্দ দাশের সঙ্গেই মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়। অথচ তাদের ভেতর অসাধারণ শিল্পনির্মাতার ছায়াটি পরিলক্ষিত হয় না এবং তারা কেউ আত্মহত্যাও করেনা।

২.

জীবনানন্দ দাশের উপন্যাসগুলোতে অসাধারণ কিছু আয়রনি বা ব্যাজস্তÍতিমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। নাটকীয় এই আয়রনিক দৃশ্যগুলোই আমাদের পৌঁছে দেবে আত্মহত্যা বনাম না-আত্মহত্যা বিতর্কের বিন্দুতে। কালো জাদুর মন্ত্র জানা জীবনানন্দ দাশ পাঠকের সামনে কালো পর্দার অন্ধকার ক্যানভাসে স্বপ্নের ঝলমলে ফানুস ওড়ান, তারপর সন্তর্পনে সেই পর্দা সরিয়ে নেন, আকস্কিকভাবে। হতবিহবল পাঠক বিভ্রান্তির চোরাগলিতে ঘুরপাক খায়, আর লেখককে বিদ্রুপ ছুঁড়ে দেয় অসহায় অজ্ঞানতায় কখনো পাগল-বদমাশ, কখনো বা দুর্বোধ্য, আবার কখনো পুনরারৃত্তিকারের কলঙ্কে। দেখা যাক, সেই পরিকল্পিত দৃশ্যসমূহ।

ক) ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসে নায়ক হেমের বাবা দুরে কোন মাঠে রাতের বেলা বেড়ালছানাকে কাঁদতে দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন। বেড়ালছানার বেদনা উপলব্ধি করে ঘরে নিয়ে এসে রাখতে চান, দুধ খাইয়ে কান্না থামাতে চান। কিন্তু একসময় জীবনের গভীর উদাসীনতা দু’জনকেই পেয়ে বসে। সৃষ্টির ক্ষমাহীনতার রহস্যময় উপেক্ষার সাথে গ্রন্থিবদ্ধ হয়ে অন্ধকারের ভিতর মাথা গুঁজে দুজনে ঝিমুতে থাকে। একসময় বেড়ালছানার কান্নার আওয়াজ পেয়ে পাশের ঘর থেকে এসে হেম দেখে বাবা ছানাটাকে কোলে করে চুপচাপ বসে আছেন চোখ বুঁজে।

‘অবাক হয়ে ভাবছিলাম, পৃথিবী সব সময় কি বাস্তবিক  অন্ধ স্রোতে চলে? নিশ্চিত বেদনা, নিষ্ফলতা ও মৃত্যুর সমুদ্রই কি জীবনকে ঘিরে রয়েছে? তা নয় হয়তো, অন্তত আবিষ্কারের জায়গা আছে, হয়তো আমারও।’ (পৃ.৮৬/কারুবাসনা)

জীবনানন্দ আশান্বিত হতে চান, নিগূঢ় অন্ধকার সত্ত্বেও বিশ্বাস করতে চান মানুষের কল্যাণময়তা আর সমবেদনায়। কিন্তু- ‘হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে গেলাম; এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম তা হলে? কোথাও বিড়ালের ছানা নেই, আলো নেই, কিছু নেই, বাবার স্থুল নাক ডাকার শব্দ শুনতে পাচ্ছি, চারদিকে অন্ধকার শ্রাবণের বাদল ও বাতাসের বীভৎস আমোদ-টিটকারি এতক্ষণে জমল তা হলে?’ (পৃ. ৮৬/কারুবাসনা)

স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ এবং নৈরাশ্যময় ফলাফলপ্রাপ্তির পুনরাবৃত্তি। তাঁর উপন্যাসে এরকম পরিকল্পিত দৃশ্যের অসংখ্য অবতারণা পরিলক্ষিত হয়।

খ) ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসে হেমের স্ত্রী কল্যাণী কোত্থেকে এক চিঠি পেয়ে কৈশোরে পরিচিত নির্মলদার জন্য উতলা হয়ে উঠে। সেই নির্মলের এখন যক্ষ্মা হয়েছে, অনাদরে এক আত্মীয়বাড়িতে পড়ে আছে। কল্যাণী তার সমস্ত গহনা বিক্রি করে তার কাছে চলে যেতে উদ্যত হয়। হেমও কল্যাণীর জায়গায় সুদূর অতীতে হারিয়ে যাওয়া বনলতাকে প্রতিস্থাপন করে তৃপ্তি  পায় এই ভেবে যে, তার যক্ষ্মা  হলে বনলতাও ছুটে আসবে এভাবে। কিন্তু পরদিনই কল্যাণী বদলে যায়,  সংসারের সাত-পাঁচ ভেবে বৈষয়িক বুদ্ধিসম্পন্ন রমণীর মতো কথা বলে। স্বামীর সেবা করে-চা বানায়, ঘর ঝাঁট দেয়, কাপড় ধুয়ে দেয়। তারপর সেজেগুজে পান নিয়ে পাড়ায় বিন্তি খেলতে চলে যায়। হেম ভাবে, ‘হয়তো বনলতাও আজ এই রকম।’ (পৃ. ৯৩/ঐ) কল্যাণী কার প্রতি অনুরক্ত, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনুরাগে  ¯ স্নিগ্ধ হয়ে ওঠা মুখ দেখে হেম হয়তো জীবনের প্রতি গভীর আশ্বাস আর সান্ত্বনা অনুভব করেছিল। পান চিবুনো, বিন্তি খেলতে যাওয়া, সংসারী রমণীর মুখ দেখে সে আশ্বাস ভেঙ্গে যায়।

গ) মাল্যবান উপন্যাসের ১০৪-৬ পৃষ্ঠায় মাল্যবান অসুস্থ হয়ে রাতের বেলা বমি করতে শুরু করলে উৎপলা এসে চিন্তিত হয়, পাখা দিয়ে হাওয়া করে, ওষুধ কেনার কথাও বলে। কিন্তু তারপরই পাখার বাতাস করতে গিয়ে তার হাত ব্যথা হয়ে ওঠে, মাল্যাবানের অবিশ্রান্ত কথা শুনতে শুনতে হাই ওঠে। মাল্যবানের কেচে রাখা ধুতিগুলো দিয়ে বমি পরিষ্কার করতে থাকে, মাল্যবানের আর্তনাদ শুনে মুখ টিপে  হাসে।

ঘ) ‘জীবনপ্রণালী’ উপন্যাসে শচীন-অঞ্জলির দাম্পত্য-বিচ্ছিন্নতার সুযোগে তৃতীয় ব্যক্তিরূপে প্রবেশ করে ধনীপুত্র অমল, অঞ্জলির প্রণয়প্রার্থী হিসেবে। অঞ্জলির প্রশ্রয়ে তাদের সম্পর্ক বেশ খানিকটা এগোয়। অমল তাকে ঘর ছাড়বার জন্য চিঠি লেখে। অমলের চিঠির মধ্য দিয়েই অঞ্জলি তার নিজের দাম্পত্যসম্পর্কের অপূর্ণ দিকটা দেখতে পায়। অনেকদিন পর স্বামীর পরিত্যক্ত ঘরে প্রবেশ করে নতুন করে সব কিছু গুছিয়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু এসব প্রচেষ্টা লেখকের চোখে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং ‘দারিদ্র্য  নারীত্ব নিয়ে অহংকার-অভিমান’ বাঙালি রমণীর। (পৃ. ১১৯) অঞ্জলি শচীনের কাছে অনুযোগ করে যে কেদারবাবু মুন্সেফের ছেলে অমল তাকে বিরক্ত করে। এই অনুযোগ এবং অমলকে লেখা নেতিবাচক উত্তরসংবলিত চিঠি থেকে আমরা তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিতে সৃষ্ট দ্বন্দ্বশেষে একটা চমৎকার পুনর্মিলনের ছবি দেখারই প্রত্যাশা করি। কিন্তু বেদনাকে যে আশরীর অচ্ছেদ্য রাখতে চান জীবনানন্দ। তাই সম্পর্ক চুকিয়ে দেবার লক্ষ্যে অঞ্জলি অমলের সঙ্গে বায়োস্কোপ দেখতে যাওয়ার দু’টাকার হিসেব নিয়ে বসে। আর শচীন তখন ধীরে ধীরে জ্যোৎস্নার পথে বেরিয়ে যেতে যেতে ভাবে:

‘এ-রকম চিরকাল চলতে পারা যায় না কি? মাঠ-প্রান্তর ভেঙে, জানা-অজানার ওপারে, জ্যোৎস্নার আকাশে-বাতাসে বুনোহাঁসের মতন, যে-পর্যন্ত, যে-পর্যন্ত শেষ গুলি এসে বুকের ভিতর না লাগে।’ (পৃ. ১৪৭/জীবনপ্রণালী)

ঙ) ‘জলপাইহাটি’ উপন্যাসে যখন ভানুকে বাঁচাবার জন্য সুবল এসে উপস্থিত হয় দেবদূতের মতো তখন আমরা আবাক হই। ‘পড়তে পড়তে চমকে উঠি, ঔপন্যাসিক কি প্রচলিত কাহিনীর ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে গেলেন? রানুকে বাঁচাতে হবে, তাই আচমকা অপরিচিত সুবলকে টেনে আনা। এই আশাবাদ উপন্যাসকে কতটা নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিল? কিন্তু বিস্ময়ের আরো কিছু বাকি ছিল যেন। নিশীথ জলপাইহাটিতে ফেরে সুমনার মৃত্যুর দিন। ফিরে এল ভানুর মৃত্যুসংবাদ নিয়ে। … ডাঃ সুবল মুখার্জি তাকে বাঁচাতে পারেনি। হ্যাঁ, মানুষের হৃদয়ে কিছুটা রৌদ্র এখনো আছে বেঁচে। কিন্তু সেই রৌদ্রে শীতল দেহে তাপ সঞ্চার করা যায়নি। আমার মনে হয় এ যেন পিতামহী, মাতামহী গ্রামবৃদ্ধেও কাছে শোনা পৃথিবীর আলো-আন্ধকারের গল্প। শীতের সন্ধ্যায় বসে বসন্তের দুপুরের গল্প। কোনো সংশয় আর থাকে না সুবল মুখার্জিকে নিয়ে। ‘যে জীবন ফরিঙের দোয়েলের’-ডাঃ সুবল মুখার্জি বা ওয়াজেদ আলি সাহেবকে সেই জীবনের কথা কল্পনা করতে পারি যেন আমরা। যদিও জানি মানুষের সঙ্গে সেই জীবনের দেখা হয় না কোনদিন, তবুও কল্পনায় বাঁচি আমরা। বেঁচে থাকি। সেই স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের জন্যই সুবলের আবির্ভাব।’

মাল্যবান-উৎপলার এই যুগল সংলাপের কিছু আগে উৎপলা বলেছিল ‘ভোর হবে না আর।’ (পৃ. ১১৩) আর মাল্যবান ভেবেছিল ‘কোনদিনও যে জেগে উঠতে হবে না আর, শীত, যা সবচেয়ে ভাল, এই বিশৃঙ্খল অধঃপতিত সময়ে সমাজে রাতের বিছানা, যা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ, সেই শীত রাতের কোনদিন শেষ হবে না আর,’ (পৃ. ঐ) মনে পড়ে যায়, জীবনানন্দ কবিতায় অন্ধকারের স্তনের ভিতর, যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো  মিশে থাকতে চেয়েছিলেন। কারণ, অস্তিত্বের ভয়াবহতা জেনে তাঁর সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়-বেদনায়- আক্রোশে ভরে গিয়েছিল; বারবার তিনি বলেছিলেন, ‘কোনদিন জাগব না আমি-কোনদিন আর।’ কিন্তু মাল্যবানকে জেগে উঠতে হয়, অন্ধকারের ভেতরই। জেগে উঠলে আমরা জানতে পারি, ভালবাসাময় যুগল সংলাপের পুরোটাই ছিল স্বপ্নমাত্র। মাল্যবানের মতো আমরাও উপন্যাসের আদ্যন্ত যে-তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই রয়ে যাই।

‘মাল্যবান’ উপন্যাসকে সমালোচক ত্রিদিব সেনগুপ্ত অভিহিত করেছিলেন ‘না-উপন্যাস’ হিসেবে। দেখা গেল আসলে তাঁর সব উপন্যাসকেই এই নামে অভিহিত করা চলে।

৩.

উল্লেখিত পরিকল্পিত দৃশ্যাবলীর সাথে তুলনীয় ‘আটবছর আগের একদিন’ (মহাপৃথিবী) কবিতাটি। এই কবিতার শেষেও রয়েছে বিভ্রান্তিকর জীবনবাদী বেশ কিছু পংক্তি যা নিয়ে অসংখ্য বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন-

ক.   ‘আমরা দু’জন মিলে শূন্য করে চলে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার’

খ.   ‘তবুও তো প্যাঁচা জাগে,

গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে

আরেকটি প্রভাতের ইশারায়-অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে’

গ.   মশা তার অন্ধকার সঙ্খারামে জেগে থেকে জীবনের

 স্রোত ভালোবেসে

রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;

সোনালি রোদেও ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কত দেখিয়াছি’

ঘ.   থুতুরে অন্ধ প্যাঁচা এসে বলেনি কি:

ঊুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?

ঙ.   চমৎকার।

ধরা যাক দু’একটা ইঁদুর এবার।

চ.   জানায়নি প্যাঁচা এসে তুমুল গাঢ় সমাচার?’ জীবনের এই স্বাদ-সুপক্ক যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকালের-তোমার অসহ্য বোধ হলো-

এই সবগুলো স্তবকে প্রবলভাবে জীবনকে আকাঙ্খা করা হয়েছে বলে কবিতাটি বিভ্রান্তিকর হয়ে পড়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয়, জীবনানন্দ খুব সুপরিকল্পিত চাতুর্যের সাথে প্রতীকের প্রয়োগ দেখিয়েছেন। জীবনের আকাঙ্খাকে বোঝাতে তিনি প্যাঁচা, ব্যাঙ, মশা, কীট, মাছি প্রভৃতি কুৎসিত দর্শন, রোগ জীবানুবহনকারী প্রাণীর উপমা এনেছেন। কিন্তু যে প্রাজ্ঞ ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন তিনি মশা-মাছির জীবন চাননি, প্যাঁচার ‘গাঢ় তুমুল সমাচার’ তাকে সেজন্যই টলাতে পারেনি।

তিনি চেয়েছিলেন ‘দোয়েল আর ফড়িংযের জীবন’ যার সঙ্গে মানুষের কখনো দেখা হয় না- লেখক এক ফাঁকে সেই তথ্য জানিয়ে দেন। কারণ, সেই ‘প্রজ্ঞাবান আত্মঘাতী’ জীবনের ‘বিপন্ন বিস্ময়’ কে অবলোকন করেছিল যা দৈনন্দিন জীবনের গতানুগতিকতা আর নিরর্থক শূন্যতার বোধ হতে জন্ম।

জীবনানন্দের উপন্যাসে, তাঁর নায়কেরা প্রজ্ঞাবান আত্মঘাতীও নয়, জীবনের বিপুল ভোগচিকীর্ষার ঘোষকও নয়। তাঁর নায়কেরা আছে তৃতীয় অবস্থানে। একজন পর্যবেক্ষকের ভূমিকায়- যিনি পর্যবেক্ষণ করেন প্যাঁচার ভোগবাদী প্রাণচর্যা, অপরদিকে এক আত্মঘাতী যার সত্যসন্ধিৎসা বধূ-শিশু-প্রেম পরিবৃত জীবনে এনেছিল জীবনের যোগ্য সংশয় ও জিজ্ঞাসা। নিরর্থক শূন্যতার ঘোরে বিপন্ন মানব অস্তিত্বের বোধ তাকে মৃত্যুমুখী হতে বাধ্য করেছিল।

এই পর্যবেক্ষকের অবস্থান সবচাইতে বিচ্ছিন্ন। কারণ, আত্মঘাতীর মত ত্বরিত সিদ্ধান্তে যে জীবনের মায়া ত্যাগ করতে পারে না আবার প্যাঁচার মত জাগতিক জীবন চর্যার পরবশ হতে পারে না। কিন্তু সে আশা করে বনহংসের মত স্বাধীন, স্বচ্ছল জীবন আর শিকারীর গুলিতে তাৎক্ষণিক মৃত্যু। অথচ তাকে অনাকাঙ্খিতভাবে টুকরো টুকরো ব্যর্থতা আর মৃত্যুকে মেনে নিতে হয় প্রতিদিন। এই স্ববিরোধিতা আর জীবনবিমুখতা তাঁর নায়কদের দাঁড় করিয়ে দেয় ঘোরগ্রস্ত শূন্যতায়। আলবেয়র ক্যামুর ‘আউটসাইডারে’র মতই তাঁর আচার আচরণ স্বাভাবিক মনে হয় না। বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে আর দশটা লোকের মত করে সে কথা বলে না বা বলতে পারে না।

‘মাল্যবান’ উপন্যাসের অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে স্বপ্নের বিস্তার। ৬৫ পৃষ্ঠায় স্বপ্নে মাল্যবান তাঁর স্ত্রী উৎপলাকে মৃত দেখে। ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে ভীত হয়ে দোতলায় স্ত্রীর কাছে চলে যায়। গ্রন্থটিতে ৬৫ পৃষ্ঠার ১২ ও ১৩ নং চরণ এভাবে দেয়া আছে-

‘ঘুম ভেঙে গেল তার।

তখন শেষ রাত।’

কবিতার মত এই ছোট পংক্তিগুলো স্মরণ করিয়ে দেয় ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার একটি চরণকে-

‘জ্যোৎস্নায়- তবু সে দেখিল কোন ভূত?

ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?’

কবিতায় আর উপন্যাসের চরণে মিল থাকলেও আদৌ মিল নেই দু’ব্যক্তির চরিত্র ও কাজে। কবিতায় যে মানুষটির ঘুম ভেঙেছে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণে কৃতি। কারণ, তার জানা ছিল ‘যে জীবন ফড়িংয়ের, দোয়েলের মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা।’

-তাই সে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু মাল্যবান ‘ন্যালা কুকুরের মত গাঁইগুঁই-গাঁইগুঁই’ করে জীবন কাটিয়ে দেয়Ñ যদিও ঘুমাবার সময় পরদিন ভোরে জেগে ওঠার কথা মনে হলে ভয় করে তার আরেকটি ‘পশুর মত অলস অর্থহীন’ দিন যাপনের কথা ভেবে। বারংবার চুড়ান্ত অপমানিত, প্রত্যাখ্যাত হয়েও স্ত্রীর কাছে ফিরে আসে শরীরের প্রয়োজনে- যদিও বেশিরভাগ সময় তা পায় না।

সন্ধ্যার পর ছড়ি হাতে গোলদীঘিতে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে অনেক উচ্চচিন্তা মাথায় এলেও বাড়ি ফিরতে হয় শুধু ‘খিদে পায়’ বলে। ‘প্রজ্ঞাবান আত্মঘাতী’ তাই সমস্ত পার্থিব চাহিদা সত্ত্বেও ক্লান্তিবোধ করে আর মাল্যবান বেঁচে থাকে অসংখ্য গ্লানি আর ক্ষুদ্রতার ভেতর।

স্বপ্ন ভেঙে মাল্যবান দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে স্ত্রীর কাছে এসে তার কুশল সংবাদ নেয়। তীব্র ব্যাঙ্গে হুল ফোটায় তার স্ত্রী- ‘আমি স্বপ্নে দেখছিলাম তোর বাবা উল্টোগাধায় চড়ে সিধে নিয়ে চলছে- বাজে শিবপুরের ব্রহ্মা মোহনবাবুকে দেবে।’ (৬৬পৃঃ/ঐ)

মাল্যবান নির্বিকার ভঙ্গিতে ফিরে আসে, যেন কিছুই হয়নি। স্ত্রীর, কন্যার, সুস্থ শরীরই শুধু তার কাম্য।

কিন্তু পাঠক জানে, মাল্যবানও মাঝে মাঝে ভাবে ‘এরকম জোড়াতালি দিয়ে জীবন কাটিয়ে কী লাভ, কার লাভ।’ (৮১পৃঃ/ঐ)

অথবা ‘উচিৎ ছিল তার একা থাকা…জীবনের সঙ্গে একজন স্ত্রীলোককে জড়িয়ে নিয়েÑ এ জড়িয়ে নেয়ার সমস্ত নিহিতার্থের ছোব-পোঁচড় গায়ে মেখে ছবিতে কাদায় মূর্খতায় ওগরানো অম্বলে আগুনে অতৃপ্তিতে কী হল সে।’ (২৬পৃঃ/ঐ)

উৎপলার কথা শুনে মাঝে মাঝে তার ভাতের থালা ছুঁড়ে মারতেও ইচ্ছে করে। কিন্তুমূল্যবান জীবনের সাথে প্রতিনিয়ত সমঝোতা করতে করতে অক্ষম, দুর্বল, ব্যক্তিত্বহীন পুরুষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিশ্চল দৃষ্টিতে সে অবলোকন করে চলে দোতলায় স্ত্রীর কাছে পরপুরুষের আসা-যাওয়া। আধুনিক মানুষের একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতা এই ভয়াবহ ব্যক্তিত্বহীনতার সূত্রে গ্রথিত।

৪.

ব্লু হোয়েলের ভিত্তিহীন অসার আতংকে এই জনপদ প্রকম্পিত ও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, কিন্তু প্রতিদিনকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাপুরুষোচিত মৃত্যুর সাথে তারা সহাস্যে মুখোমুখি হয় প্রতিদিন। প্রতিদিনকার সেইসব অপমানিত-গ্লানিকর-পরাজিত-বিবমিষাময় জীবনযাপনকে আমরা গর্বভরে নাম দিয়েছি জীবন সংগ্রাম। সমাজ কাঠামোর যে-কোন অবয়বেই আমজনতার রিলে রেসটি ‘জিবরাইলের ডানা’ গল্পের সেই নাটাইর সুতার মত সীমাহীন, যা দিয়ে অসীম দুরত্বে অবস্থানরত কাঙ্খিত ‘সুখ’ নামক ঈশ্বরকে ধরা যায় না। তবুও, মধ্যবিত্তের জীবন সংগ্রাম ইজ টু বি কনটিনিউড। এই চক্র থেকে যারা ব্যর্থতায় ছিটকে পড়ে, তাদেও প্রতি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর  (তেলাপোকা নয়) অশেষ ঘৃণা-অবজ্ঞা জারি ছিল এবং থাকবে!

Leave comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *.