শিল্পীর অনুভব ও সত্যজিৎ – আনোয়ার হোসেন পিন্টু

‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ বালক রবি ঠাকুরের লেখা এই চারটি শব্দের সম্মিলিত অর্থ সাধারণ হলেও একটি চিত্রকল্প তা আমাদের টেনে নিয়ে চলে প্রকৃতির অবগাহনে। সুতরাং বলা যেতে পারে অতি সাধারণ বাক্যের মালা গেঁথেও রচনা করা যায় অসাধারণ কোন শিল্পবোধের মালা। দেখেও যে দেখে না, শুনেও যে শুনে না সে কখনো হতে পারে না প্রকৃত শিল্পী। সেই হলো প্রকৃত শিল্পী যার ‘ইনার আই’ প্রখর। তারপরও থেকে যায় আরো একটি জরুরী বার্তা যা আমি আঁকছি ক্যানভাসে, পাথরে, খাতায় কি সেলুলয়েডের ফিতায় তার মধ্যে শিল্পবোধ কিংবা নান্দনিক মাপকাঠি কতটা গভীর।

প্রত্যেক শিল্পের থাকে দুটো দিক। বিষয় ও প্রকরণ। বিষয় যাই হোক, এমন কি অতি সাধারণ বিষয়ও প্রকরণ বা আঙ্গিকের গুণে হয়ে ওঠে মনকাড়া ও মননাড়া দেওয়া মুহূর্ত।

চলচ্চিত্র বা সিনেমা হলো শিল্পের বারোয়ারী মিলনের ফসল। যেখানে আছে সাহিত্য, সঙ্গীত, আলোকচিত্র, স্থাপত্য, থিয়েটারসহ আরো নানাবিধ শিল্পমাধ্যম। সব নিয়ে সে যেমন সিনেমা আবার সব নিয়ে সে বড় কঠিনতম মাধ্যম। কারণ একজন যথার্থ চলচ্চিত্রকারের সব শিল্পমাধ্যম সম্পর্কে সামান্যতম হলেও জানা থাকা চাই উপরোক্ত শিল্পমাধ্যমগুলির ধরন ও ধারণ। না হয় শিব গড়তে হয়ে উঠবে বানর।
মনে পড়ছে, কবি জীবনানন্দের মোক্ষম সেই বাণী- ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’ একই সুরে যদি বলি শত দেশে প্রতিদিন নির্মিত শত শত চলচ্চিত্র ক’টিই বা প্রকৃত চলচ্চিত্র ? সব থেকেও যে সিনেমা বা চলচ্চিত্র মনকে টলাতে পারে না সে কিছুতেই হতে পারে না প্রকৃত সিনেমা। সত্যিকারের সিনেমা হয়ে উঠার জন্য প্রয়োজন অন্য একটি এলেম। কি সেই এলেম ?

সত্যজিৎ এবং বিনোদবিহারী

মনে করা যাক, সত্যজিতের চিত্রশিল্পী বিনোদবিহারীকে নিয়ে তৈরি প্রামাণ্যচিত্র ‘ইনার আই’এর কথা। হয়তো অনেকেরই জানা বিনোদবিহারী শেষ বয়সে হারিয়েছিলেন দৃষ্টিশক্তি। অন্ধ হয়েও তিনি কিন্তু থেমে থাকেন নি। সৃষ্টি করে গেছেন অনেক অনন্য শিল্পকর্ম, অন্তর্দৃষ্টির শক্তি মত্ততায়। তাঁর দৃষ্টিশক্তি থাকাকালে একটি ল্যান্ডস্কেপ এঁকেছিলেন তিনি। উক্ত ছবি আঁকার শেষ দিকে তিনি হারান দৃষ্টিশক্তি।
সত্যজিৎ দৃশ্যটি তুলে ধরেন এইভাবে –
পুরো ফ্রেম জুড়ে তিনি প্রথমে দেখান ল্যান্ডস্কেপ ছবিটি। এক সময় ছবিটির উপর ঢেকে দেন তিনি ফেডআউট অর্থাৎ পর্দা হয়ে ওঠে অন্ধকার। তারপর ফেড ইন হওয়ার পরও কিছুতেই হয়ে ওঠে না পর্দা আলোকিত। একসময় ক্যামেরা পিছিয়ে আসে ধীরে ধীরে পিছনে। আমরা দেখি, শিল্পী বিনোদবিহারীর চোখে পড়া ডার্ক সানগ্লাসের উপর ক্যামেরা ছিলো খানিক মুহূর্তের জন্য স্থির। পরে ধীরে ধীরে জুম ব্যাক করে ক্যামেরা পিছিয়ে এনে সত্যজিৎ সৃষ্টি করেন এক অনবদ্য মুহূর্ত।

মনে করা যাক তাঁর ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবির আরেকটি দৃশ্যের কথা। দেশটির বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রিত অতিথিরা আসছেন হীরক রাজার দেশে। বিভিন্ন সাজসজ্জায় সজ্জিত পুরো হীরক রাজার দেশ। তৈরি করা হয়েছে বিশাল তোরণ। এক্সট্রিম লং শটে ক্যামেরা বসানো। দূর থেকে দেখা যায় রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে অনেক হাতি। আর হাতির পিঠে চড়ে তোরণ পেরিয়ে ঢুকছে বিদেশী অভ্যাগতরা। ক্যামেরা জুম হতে থাকে তোরণের দিকে। দেখি, তোরণের উপরে লেখা ‘স্বাগতম’ শব্দটি। যেটি আসলে লেখা থাকার কথা তোরণের বিপরীত দিকে অর্থাৎ অতিথিদের প্রবেশ পথের দিকে। কোন সংলাপ ছাড়াই সত্যজিৎ বুঝিয়ে দেন- যে রাজা আসলে হঠকারী ও শয়তান, তার মন-মানসিকতাকে তুলে ধরেন উক্ত ‘স্বাগতম’ শব্দটি উল্টো করে লিখে।

ছোট বড় মিলিয়ে সত্যজিৎ তৈরি করেছেন পঁয়ত্রিশটি ছবি। ভাবতে অবাক লাগে, পঁয়ত্রিশটি ছবিতেই তিনি বিষয়বস্তুকে করে তুলেছিলেন নানাসব অনবদ্য অলংকারে অলঙ্কিত।

লেখার ইতি টানছি সত্যজিতের নিজের একটি কথা দিয়ে- উক্ত কথা থেকেই আমরা বুঝে নিতে পারি প্রকৃত শিল্পী ও শিল্পের মূল চাবিকাঠি কি?

“ শিল্পীর চোখে দেখা বা শিল্পীর কানে শোনা বা মন দিয়ে অনুভব করা সাধারণ লোকের চেয়ে সূক্ষ্মতর ও নিবিড়তর হতে বাধ্য- তা না হলে তিনি শিল্পী হবেন কী করে?”

১৩-১০-২০১৭