রাসেল এডসনের কবিতা- ভূমিকা ও ভাষান্তর – মাজুল হাসান

রাসেল এডসন: টানাগদ্যের গডফাদার ও একজন মিস্টার লিটল প্রোজ পোয়েম

রাসেল এডসন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, ইলাস্ট্রেটর, কার্টুনিস্ট, ছোট গল্পকার ও উপদেশমূলক গল্পের রচয়িতা। ছবি এঁকেছেন; করেছেন নিজের বইয়ের প্রচ্ছদ। তবে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক টানাগদ্য কবিতার পুরোধা ব্যক্তিত্ব। রাসেল টানাগদ্য কবিতা লিখছেন তখন থেকে যখন সেটা ফ্যাশনবেল হয়ে ওঠেনি। সত্তরের দশকেও অ্যালেন জিন্সবার্গরা যখন তীব্র রাজনীতি সচেতন কবিতা লিখে চলেছেন, তখনও একনিষ্ঠ সাধকের মতো রাসেল এডসন তার নিজস্ব প্রোস পোয়েট্রি চালিয়ে গেছেন। তবে সে সময়ে তেমন সাড়া জাগাতে পারেননি তিনি ও তাঁর প্রোস পয়েম। কিন্তু বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে টানাগদ্য কবিতার প্রবাদপুরুষে পরিণত হয়েছেন রাসেল। তরুণদের ওপর তার প্রভাবও যথেষ্ট। ১৯৩৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট স্টেটে জন্ম নেয়া রাসেল সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন জেমস রাইট, অ্যালেন জিন্সবার্গসহ বিভিন্ন মাইগ্রান্ট কবিকে, যাদের মধ্যে যুগোস্লাভিয়া থেকে চলে আসা চার্লস সিমিক অন্যতম। তবে টানাগদ্য কবিতাকে মার্কিন মুল্লুকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর মূল কৃতিত্ব আসলে রাসেল এডসনেরই। তার কবিতাগুলো পরাবাস্তব ঘোর তৈরিতে অতুলনীয়। অনেকে এসব কবিতাকে স্যুররিয়াল কবিতাও বলে থাকেন। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সমালোচক ডোনাল্ড হল-এর মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলছেন—

‘whatever his method of writing, (he) makes surreal poems. Few poets have ever written as Edson does, out of a whole irrational universe – infantile, paranoiac – with its own small curved space complete to itself, impenetrable by other conditions of thought.’ (American Poetry Review, 1977).
যদিও বিষয়টাকে স্যুররিয়েলিজম মানতে নারাজ রাসেল এডসন। ১৯৯৯ সালে The Prose Poem: An International Journal পত্রিকার সম্পাদক পিটার জনসন এ বিষয়টা নিয়ে তার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন- Why should we have to be surrealists? Breton didn’t invent our imaginations.
তবে তাঁর কবিতায় উদ্ভটত্ব এতো বেশি যে তাকে যুক্তি ও কাব্যকলার আলোকে ব্যাখ্যা করা বেশ দুরূহ। কোনো লোক জুতোকে বিয়ে করছে, স্ত্রী তার স্বামীকে খাবার হিসেবে বনমানুষ সার্ভ করছে… এসব বিষয় কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? এ যেন উদ্ভট সময়ের উদভ্রান্ত মানুষের প্রলাপ বর্ষণ। সারা ম্যানগুসো’র মতো নবীন লেখকরা এই বিষয়টাকে চিহ্নিত করছেন ‘an exploration of the possibility of logical nonsense’ হিসেবে। কিন্তু শুধু প্রলাপ বা উদ্ভট বলে এডসনকে খারিজ করে দেয়া যায় না। কারণ, এডসনের ‘ইললজিকাল লজিক’ কীভাবে যেন একটা ভিন্ন জগৎ তৈরি করে পাঠককে আবিষ্ট করে রাখে। মূলত বর্তমান মার্কিন সমাজের আনস্ট্যাবল, ইররেশনাল ও ইললজিকাল কনসিকুয়েন্সকে ধরার চেষ্টা করেছেন এডসন। আর তেমনটি করতে গিয়ে তিনি বিদ্রুপাত্মক হয়ে ওঠেন, কখনো কখনো হয়ে ওঠেন হেয়ালিপূর্ণও। আর পুরো পরিস্থিতিটি কাব্যবন্দী করতে তিনি একটি অতিপ্রাকৃত সারাউন্ডিংস তৈরি করে নেন। তবে তার কবিতায় অতিপ্রাকৃত ও অত্যাশ্চর্য চমকগুলো পাঠকের সাথে দূরত্ব তৈরি করে না, বরং সেই পরিবেশ কেমন যেন বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। কবিতায় বস্তু ও জীবের মধ্যে সত্তাগত ফারাক ঘুঁচে যায়। তাই পরীদের কান্নার পাশাপাশি তার কবিতায় কান্না জুড়ে দেয় ক্লীব রুটি (রুটি), কফির সাথে যুদ্ধ বেঁধে যায় মানুষের (যুদ্ধ), স্ত্রী তার স্বামীকে মেন্টিং মেশিনে গলিয়ে সতেরটা ছোট ছোট স্বামীর ক্ষুদে সংস্করণ তৈরি করেন—এমন অনেক আপাত অযৌক্তিক চিত্রকল্প এডসনের কবিতায় অহরহ চলে আসে। অবশ্য ‘চলে আসে’ না বলে এটাকে বরং বলা উচিত এডসনের নিজস্ব রীতি, বিশেষত্ব। এই রীতিটাকে ঠিক ম্যাজিক-রিয়েলিজম বা স্যুররিয়েলিজম বলা যায় না, রিয়েলিজম তো নয়ই। তবে একটি বিষয়: তার প্রতীকায়ন ও ইমেজ যে ভিন-জাগতিক ইলিউশন তৈরি করে এতে কোনো সন্দেহ নেই। যেখানে যে কোনো কিছুই সম্ভব। মানুষ ষাঁড় হয়ে যেতে পারে (ষাঁড়), বাবা-মা তাদের ছেলেকে বলতে পারে- বাপু তুমি গাছ হয়ে গেছ, তা হও, কিন্তু শেকড় ফুঁড়ে মেঝের কার্পেটটা নষ্ট করো না (ঝরাপাতার দিন)।

ঘুম

লোকটা ঘুমের কায়দা-কানুন জানে না। তবু রাতে বেশ্যার মতো অপেশাদার ঘুমের কাছেই মাথা গুঁজে দেয় সে।

ঘুমের ম্যানুয়াল পড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা তাকে কেবলই ঘুম পাড়িয়ে রাখে, সেই একই ক্লান্তিকর ঘুম…

আসলে তার একজন ঘুমের ওস্তাদ দরকার। যে কিনা চেয়ারে বসে চাবুক হাতে ফিরিয়ে আনবে রাতের শৃঙ্খলা। যে কিনা রাতকে পার করে দেবে গ্যাসোলিন কুণ্ডলীর ভেতর দিয়ে। বাঘের মতো সুদৃঢ় এমন এক ওস্তাদ যে কিনা বসে থাকবে মূর্তির ছোট্ট পাদভূমিতে আর হাই তুলবে…

রুটি

আমি সুদৃশ্য রুটি পছন্দ করি। প্রত্যাশার মতো রুটি। যে রুটি পাওয়া যায় ক্ষুধাতুর স্বপ্নে।

একদিন সেরকম একটা রুটির সাথে আমার দেখা হয়ে গ্যালো। তখন আমি সবে দরজায় টোকা দিয়েছি (আঙুলের গাঁটের শেপ ঠিক রাখতে যেমনটি আমি প্রায় করে থাকি) আর তখনই বেরিয়ে এলো দেহাতী সাইজের এক মহিলা (তার দৃষ্টি অমথিত ময়দার মতো)। হাতে তার এক খণ্ড সুদৃশ্য রুটি।

একটা কামড় বসাতেই রুটিটা কান্না জুড়ে দিলো…

স্তন

কোনো এক রাতে একটি স্তন এসে হাজির হলো পুরুষের ঘরে। সে তার যমজ-বোনের কথা বলতে শুরু করলো।

তার যমজ বোন এই করে, তার যমজ বোন অই করে, এইসব।

শেষমেশ লোকটা বলল, প্রিয় স্তন, তোমার নিজের খবর কি?

এরপর বেচারা স্তন পুরো রাত কেবল নিজের কথাই বলে গ্যালো।

আসলে সে তার নিজের সম্পর্কেও একই কথা বলছিল। আমি হেন আমি তেন, এই রকম আরকি।

অবশেষে, লোকটা স্তনবৃন্তে চুম্বন এঁকে দিয়ে বলল, আমি দুঃখিত। তারপর সে ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গ্যালো…

তুমি

কিছু না’র ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা সময়। তার নাম শৈশব। ওটা আসলে একটা পথ, চলে যায় বিজয় তোরণ চিরে। ওর নাম বয়ঃসন্ধি। তোরণ ঘেঁষা একটা শহর, নাম যৌবন। তারপর পথ, মানুষ যেখানে মিস করে ফুলের জীবন। ছোট্ট কুঁড়েঘরের মতো ওটাই তুমি। আর এই যে, ভবিষ্যৎ বেঁচে আছে জানালার কার্নিশে, হাতের গুটিকয় ভঙ্গিমা, দ্যাখো : হাঁটুতে তুলে দেয়া পায়ের গোড়ালি, হাতে ঢাকা মুখ; কখনো-সখনো মাথা মুড়ে যায় পেছনে, ছাদের গায়ে ঘুরে বেড়ায় চোখ… এটা দিনের দীর্ঘ বৃত্তচাপ, যেখানে কিছুই নেই…

সাঁকো

যাত্রাপথে লোকটা এসে গেছে এমন এক সাঁকোতে যার পুরোটাই হাড়ের তৈরি। সেটা পেরুবার আগে লোকটা মাকে চিঠি লিখল: মাগো, বুঝতে পারছ, একটা ভল্লুক কলা খেতে গিয়ে কামড়ে দিয়েছে নিজের হাত। ঠিক এই মুহূর্তে আমি আছি হাড়ের সাঁকোর পাদদেশে। কিছুক্ষণের মধ্যে পার হব। জানি না, ওপারে মাংসের পাহাড়- উপত্যকার দেখা পাব কিনা, নাকি স্রেফ জমাট রাত, নিদ্রামগ্ন গ্রাম। ভালোমতো না পড়ানোর জন্য বনমানুষটা খিটমিট করছে। সান্ত্বনা দিতে, তাকে পরতে দিয়েছি আমার তরুমজ্জার হেলমেট। ব্রিজটা দেখতে অনেকটা জাদুঘরের অতিকায় ডায়নোসরের কঙ্কালের মতো। বনমানুষটা হাতের ফুটির দিকে তাকিয়ে আবারো পীড়াপীড়ি শুরু করেছে। আমি তাকে আরেকটা কলার প্রস্তাব দিলাম , কিন্তু বেটা অগ্নিশর্মা, যেন ওকে অপমান করেছি। কাল আমরা সাঁকোটা পেরুবো। ওপার থেকে চিঠি লিখবো তোমায়, যদি পারি, না হলে খুঁজে নিও অদৃশ্য ইঙ্গিত…

বনের ভেতরের কটেজ

নিজ হাতে বনে কটেজ গড়েছিল সে। যেখানে পতঙ্গ ডানার ঘর্ষণে গান।

ছিল না মাপজোখ, না যথার্থ পরিমাণ জ্ঞান; তাই কটেজ হলো খুবই ছোট্ট। ধরা পড়লো যখন দরজা দিয়ে শুধু গলানো গ্যালো হাত। গুটিগুটি আঙুল দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে প্রধান ফটকে আটকে গ্যালো বাহু।

লোকটা ভাবে, এখন তবে কিভাবে রান্না হবে রাতের খাবার। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে কেবল তো হাতটাই ঢোকে; তার ওপর এত ছোট্ট স্টোভ; কিভাবে রান্নাবাড়া সম্ভব। কটেজে চাদরমোড়ানো বিছানা আছে অপেক্ষায়, তবু তাকে কাটাতে হবে উদ্বাস্তু রাত।

নিজেকে মুড়ে কটেজ ঘিরে শুয়ে পড়লো সে; আর শুনতে লাগলো পতঙ্গের ডানার ঝাপটানি গান…

মনুষ্য জীবন

ব্রেকফাস্টে মানুষকে একটা ডিম ফাটাতেই হয়। এ নিয়ে রাজার অশ্ব ও সামন্ত দলের খুব বেশি কিছু করার থাকে না।

ঘটমান অতীত, ফাটানো ডিম আর কখনো ফাটানো যায় না, যেমনি মৃত ব্যক্তি মরে না দ্বিতীয় বার…

আর যখন মানুষ ফাটানো ডিম ছেড়ে দেয় ফ্রাইং প্যানে, শুরু হয় কলকাকলি, আহ, বেশ, এই হামটি ডামটিটা যা পাঁজি না…

ট্যাক্সি

এক অন্ধকার রাতে ট্যাক্সির জন্য ফোন করেছিলাম। সাথে সাথে দেয়াল ভেঙ্গে চলে আসলো ট্যাক্সি। কোনো সমস্যা নাই, আমার ঘর তিন তলায়, হলুদ ক্যাবচালক আদতে ক্যানারিগুচ্ছ দিয়ে তৈরি অথবা সেগুলো সাজানো আছে একজন ড্রাইভারের আদলে, ক্যানারিগুলো এদিক-ওদিক তড়পাচ্ছে, হলুদ ঝর্নাধারায় বাষ্প বেরিয়ে আসছে ট্যাক্সির জানালা দিয়ে…

বুঝতে পারলাম, অনেক বড় কিছুর মধ্যে ফেঁসে গেছি, সাথে সাথেই টেলিফোনের দিকে ছুট, বাতিল করলাম ট্যাক্সি। সব ক্যানারি ট্যাক্সির ভেতরে ঢুকে পড়লো, নিজে নিজে থরে থরে রূপ নিলো জমাট মানুষের আদলে। দেয়াল দিয়ে উল্টো পথে ফিরে গ্যালো ট্যাক্সি, ঠিক হয়ে গ্যালো দেয়াল…

কিন্তু যা কিছু হচ্ছে তাকে কিছুতেই থামাতে পারছি না আমি। আবারো ট্যাক্সি ডাকতে আমি চলে এসেছি ফোনের কাছে, এর মধ্যেই দেয়াল ভেঙ্গে ট্যাক্সি ক্র্যাশ… শুরু হয়ে গ্যাছে হলুদ ক্যাব ড্রাইভারের তড়পানি…

ভেড়া

ওরা বাড়িতেই। মেঝেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে মেঘের মতো । শোবার ঘরেও ওরা। ফিরে আসছে ভূগর্ভস্থ ভাণ্ডার থেকে। ধুলার বলের মতো চরে বেড়াচ্ছে চিলেকোঠায়।

একটা লোক বসে আছে রান্নাঘরে, দুহাতে মুখ ঢাকা; কাঁদছে। আঙুল গলিয়ে সিঞ্চিত হচ্ছে অশ্রু।

ভ্যা-ভ্যা স্বরে ভেড়া আসে, জড়ো হয়, হাত থেকে চেটে খায় নুন। ঋতু উত্তাপে একটা ভেড়ী মিষ্টি হেসে নিজে করে সমর্পণ।

ভেড়া চড়ে বসে তার পিঠে, মুখ লুকায় উলেল স্তনে…

উইস্টার স্টাফিং

সময়টা নভেম্বরের শেষ বৃহস্পতিবার এবং একটা বড় টার্কি খুন হলো…

তারা বলল, সে তখন ঘুমাতে যাবার ঠিক আগে একটা রান্নার বই পড়ছিল। তারা জানালো, সে তখন সবে তার পকেট ঘড়িটা নাড়াচাড়া শুরু করেছে, মনে হয় দম দিচ্ছিল আর দেখতে চাচ্ছিল সময়। একটা পালক লেপ্টে ছিল ঘড়ির দমদণ্ডে।

বিছানার পাশে টেবিলে খোলা কালির দোয়াত, তাতে গুঁজে রাখা পালক-কলম। পরিষ্কার বোঝা যায়, টার্কি তখন রান্নার বইয়ে দেগে রাখছিল উইস্টার স্টাফিং-এর রেসিপি…

তার মাথা, এখনো ঘুমটুপি পরা, ছিল বালিশের ওপর। সম্ভবত জানালা দিয়ে দেহটা টেনে-হেঁচড়ে তুষারের ওপর দিয়ে নেয়া হয়েছিল উঠোনে…

হলিডের কারণে থমকে গ্যাছে তদন্ত; আর পরিবার-পরিজন নিয়ে বেশির ভাগ পুলিশই এখন উপভোগ করছেন থ্যাংকস গিভিং ডিনার…

** উইস্টার স্টাফিং: বিশেষ খাবার। মার্কিনিরা সচরাচর এই খাবার পরিবেশন করে থাকে থ্যাংকস গিভিং ডে-তে। এই দিনটি পালিত হয় নভেম্বরের শেষ বৃহস্পতিবার।

** টার্কি: বড় ধরনের মোরগ সদৃশ পাখি, টার্কি নামেই পরিচিত