চিরযুবক – আখতার মাহমুদ

‘অত তরুণ, অত বিষণ্ন মানুষ কখনো দেখিনি। নতুন সহকর্মী হিসেবে প্রথম পরিচয়ের প্রায় ছ’মাস পর যখন ভারত থেকে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরে, তখন যেন আরো তরুণ দেখায় তাকে। আরো বেশি বিষণ্নও। ভীষণ তরুণ বিষণ্ন কেউ কিশোরীদের হ্যাংলা করে তুলতে পারে, আমার মত কাউকে না। আমার তখন আঠাশ। আঠাশ বছরে হ্যাংলামো কোথাও ফিট করে না। কিন্তু অত বিষণ্নতা আর কারো মুখে দেখিনি বলেই ওই বয়সেও হ্যাংলামো পেয়ে বসে। নির্লজ্জের মত আলাপ করতে এগোই। প্রথম পরিচয় স্মরণ করিয়ে দিই বারে বারে। একই প্রতিষ্ঠানে চাকুরির সুবাদে কথা-বার্তাতো চলতেই পারে, তাই না? পরের এক সপ্তাহেও আলাপ খুব বেশি গড়ায় না। কেননা সে একবারও হাসেনি। যদিও নানা কারণে কথা হতে থাকে অনবরত। সমস্ত আলাপ এক করেও খুঁজে পাইনি তার এক চিলতে হাসি। হাসিহীন মানুষদের সাথে আর যাই হোক আলাপ জমে না। ওরা বন্ধুও হয়ে ওঠে না। করুণ জীবন বাঁচে। কেউ অনাগ্রহী হলে আলাপ টেনে নিয়ে যাওয়া দুঃসাধ্য। তবু কিছুটা জেদে, কিছুটা মেয়েলী খেয়ালিপনায় তাকে ভাঙব বলে গায়ে পড়ে আলাপ টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে চলি। অফিস ছুটির পর একদিন তরল কণ্ঠে বলি- দিন দিন এত তরুণ হয়ে ওঠেন কী করে? দেখেই মনে হয় বয়স কমে চলে আপনার। কী ক্রিম মাখেন?

-আমাকে চিরযুবক ধরে নিন। মৃদু উদাস বিষণ্ন স্বরে উত্তর আসে। সে স্বরে তামাশা-ঠাট্টার ছিটেফোঁটাও নেই।

-তাই?

-জ্বি।

-চলুন আজ আপনার বাসায় গিয়ে চা খেয়ে আসব।

-কিন্তু আমার যে অফিস শেষে বাসায় ফিরে ঘুমানোর অভ্যেস?

এটা সরাসরি অপমান কিংবা গালে চড় দিয়ে উৎসাহ কমিয়ে দেবার মত উত্তর। তবু ওই যে জেদ? প্রচন্ড রাগ সামলে বলি- তাতে কী, আপনার বাসার লোকদের সাথে আলাপ করব। আপনি অভদ্রের মত প্রয়োজনে গিয়ে ঘুমাবেন। বাসায় কে কে থাকে?

-দুই নাতি।

-কে!

-নাতি। বড়জন আমার বয়সী। ছোটজন কলেজে পড়ে।

-সরাসরি বললেই পারেন, আমার সাথে আলাপে ইচ্ছুক নন। ফালতু কথা কেন বলেন?

মানুষটা ব্যথাতুর চোখে তাকায়।- ফালতু বলি না। মিথ্যে বলি না। পৃথিবীর একমাত্র হতভাগ্য মানুষ ভেবে নিন আমাকে। কেউ জিজ্ঞেস করলে মিথ্যে বলতে পারি না। মানুষের অপ্রয়োজনীয় আগ্রহে বার বার বিপদে পড়ি। অথচ কারো ক্ষতি করতে যাইনি কোনোদিন। কোনোদিন না। আগ বাড়িয়ে কারো সাথে আলাপ জমাতেও যাইনি কোনোদিন। কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে যেমন অনাগ্রহ আমার তেমনি আমার প্রতি লোকে অনাগ্রহী হলেই সুখি হই। আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না কিছু জানতেও চাইবেন না। হাতজোড় করি। প্লিজ।

এরপর জেদে লাগাম পরাই কিছুদিনের জন্যে। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে যায়, আমরা প্রবেশ করি ফেসবুক যুগে। ফেসবুকে আবেগ-সামাজিকতা আমরা সবরকম উপায়ে খুব যত্ন করে তুলে রাখতে শিখি। আর নিজ নিজ দেয়ালে প্রত্যেকেই হয়ে উঠি এক একজন স্বেচ্ছাচারী শিক্ষক। একবছর পর তাকে আরো তরুণ আরো বিষণ্ন মনে হতে থাকে। একইসাথে জেদ লাগাম খুলে বেরিয়ে যাবার তীব্র চেষ্টায় অস্থির হয়ে পড়ে। তার ক্রমাগত তরুণ-সজীব হয়ে ওঠার পেছনের কারণ জানতে না পেলে যেন মারাই যাব- এমন অনুভূতি হতে থাকে। সে বছর অফিস পিকনিকে গিয়ে জেদের লাগাম ছেড়ে দিই। আসলে জেদের কাছে হার মানি। স্বীকার করি, ওটা ছেলেমানুষি জেদ। কারো ভেতর থেকে কথা বের করার, কাউকে জানার, কারো হাসি দেখার অমন জেদ হয়তো আশির দশকে মানাতো। ফেসবুক যুগে অমনতর জেদের সময় মানুষের কোথায়? বা মানুষের আধুনিক অহংবোধ অমন জেদ দেখাতে উদগ্রীব হবেও বা কেন? কোনো যুক্তি নেই, তবু জেদে অটল থাকি। একদিক থেকে ওই হ্যাংলামো বা জেদ আমার উপকার করে। অবশেষে জাফলংয়ে কাঁচ স্বচ্ছ টলটলে জলের সামনে মৃদু বিকেলে দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করি, বিশেষ করে যখন সে বলে- শেষপর্যন্ত মিলিয়ে যাব একদিন। তখন বুঝি, মানুষটা বেঞ্জামিন বাটনের মত একজন। আরো আবিষ্কার করি কিংবা সিদ্ধান্ত নিই, মানুষটা সময়ের গহ্বরে মিলিয়ে যাবার আগমুহূর্ত পর্যন্ত তাকে ভালবাসব, তারপরেও বাসব এবং মৃত্যুর আগে আমার জীবনে দ্বিতীয় পুরুষ থাকবে না….. ফিৎজারেল্ডের সেই বিখ্যাত গল্পটা নিশ্চয়ই পড়া তোমার? কিউরিয়াস কেইস অফ বেঞ্জামিন বাটন?’

সময়টা দারুণভাবেই গল্প শোনার। একটানা বৃষ্টি। বৃষ্টির রিমঝিম বাদে নিঃশব্দ চারিদিক। সুস্বাদু সব খাবার সামনে। পরিবেশনটাও অসাধারণ। আবহও। বিদ্যুতের বাতি ইচ্ছাকৃত নেভানো। শুধু ভারি বড় মোমবাতির আলোয় উদ্ভাসিত আমরা। আমাদের ছায়ারা কোনো অনাবশ্যক নড়াচড়ায় হঠাৎ হঠাৎ বিশাল হয়ে ওঠে। পরিবেশটা গল্পের সাথেই মিলে-মিশে একাকার। গল্পকথকও দারুণ মানুষ। প্রথম দেখাতেই মুগ্ধতা আকাশ ছোঁয়। মানুষ এমন সহজ-আপন আচরণ করতে পারে, বিশ্বাস করা কঠিন। ভদ্রমহিলাকে দেখার আগ পর্যন্ত নিজেও বিশ্বাস করিনি। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে কোনো কলেজের প্রফেসর ছিলেন। ফলে এতকাল দেখা হয়নি। দেশের মায়ায় দেশে পা রাখেন গত বছর। দেশে এসেই একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ভদ্রমহিলা সম্পর্কে খালা শাশুড়ি। বয়স চল্লিশ। প্রথমবার দেখেই ধাক্কা লাগে। বয়স ত্রিশের অধিক মনে হয় না। আমার বউ খালার পনেরো বছরের ছোট হওয়া সত্ত্বেও তাদের সমবয়সী বলে যে কেউ ভুল করবে।

খালা বিয়ে করেন নি। একলা থাকেন। দেখা-শোনার জন্যে রাখা দু’চারজন কাজের লোকই তার আপনজন। অঢেল সম্পত্তি ভদ্রমহিলার। তার বিয়ে না করার গল্প, একলা থাকার গল্প শুনি। তন্ময় হয়ে। গল্প শুনতে আসার আগেই বউ বেশ কিছুদিন ধরে আগ্রহ তুঙ্গে তোলে। জানায়, খালার বাড়িতে বেড়াতে গেলে একটা অবিশ্বাস্য গল্প শুনতে পাব। সে নিজেও কখনো গল্পটা শুনে উঠতে পারেনি। দীর্ঘসময় নিয়ে খালার বাড়িতে বেড়াতে গেলে গল্পটা শোনাবে খালা। গল্পে আগ্রহ চিরকাল আমার। ফেসবুকে টুকটাক লিখি। মানুষের অগভীর জীবনের গল্পগুলোও তাই গভীর মনোযোগে শুনি। কোন লেখায় কখন কোন গল্প কাজে লেগে যায় কে বলতে পারে? বিভোর হয়ে গল্প শুনতে শুনতে হঠাৎ প্রশ্ন ছুটে আসায় ভাবনার তাল হারাই। ধাতস্থ না হয়েই প্রশ্ন করি, ‘বেঞ্জামিন কী?’

‘বাটন। গল্প। পড়োনি?’

‘ওহঃ। না। সিনেমাটা দেখেছি। দুর্দান্ত।’

স্পষ্ট দীর্ঘশ্বাস চাপেন তিনি। ‘সিনেমাটা রিলিজের আগেই তাকে হারাই। আমারই দোষে।’

কারো ব্যক্তিগত শোক-তাপে আমার আগ্রহ নেই। প্রশ্ন করি, ‘আপনার জেদ হার মানায় তাকে, শেষতক?’

‘অত সহজ মানুষ তাকে ভেবো না। আঘাতের পর আঘাত পাই তার থেকে। বেশিরভাগই সরাসরি অপমান। একদম রাখ-ঢাক না রেখেই। কী-সব বিশ্রী তীব্র অপমান সে-সব! দুটো গান- আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম, তুই যদি আমার হইতিরে… এক অফিস আড্ডায় ঠাট্টাচ্ছলে গেয়ে ওঠায় বলে- আপনি খুব অশ্লীল। দুটো গানেই অশ্লীল লাইন উপস্থিত।…. কোন মেয়ে এই কথা শুনে রাগবে না? সে চিরযুবক বা দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারে, তাই বলে নারীর প্রতি সাধারণ সম্মানটা সে দেখাবে না? নারীর প্রতি সম্মান দেখানো তো সাধারণ বোধ থেকেই আসে। বোধ-উপলব্দি নেই তার?- এসব ভেবে রাগ হতো খুব।’

‘ওই ব্যাপারটা কী আসলে… নিজেকে চিরযুবক বলার ব্যাপারটা?’

‘যুবা বয়স দীর্ঘসময় উপভোগ করার সুযোগ হওয়াতেই সে নিজেকে চিরযুবক বলতো আসলে। জাফলংয়ের সেই অফিস পিকনিক… না পিকনিক অবশ্যই নয়; সেই টলটলে জল, ঝকঝকে আকাশই তার প্রাচীন স্মৃতি উসকে দেয়। তার মনে পড়ে অনেক পেছনের স্মৃতি। স্ত্রীর প্রয়াণ। শোকার্ত মানুষটার চুলে কখন আদুরে আঙুলে কিলিবিলি কাটতে শুরু করি গল্প শুনতে শুনতে, কখন সে আমার কাঁধে মাথা হেলিয়ে শিশুর মতন ফোঁপাতে শুরু করে টেরই পাইনি। অন্যদের, কলিগদের বিস্মিত দৃষ্টি হাতড়ে বুঝি- আমার জন্ম ওর ভরসা, শক্তি হয়ে ওঠার জন্যেই। সেদিন অদ্ভুতভাবেই আচমকা কলিগদের চোখে পড়েও আমরা অপ্রস্তুত হইনি। যেন ব্যাপারটা একদম স্বাভাবিক। এমনটা যেন প্রায়শই ঘটে থাকে। রাতে ক্যাম্পফায়ারের আলোতে জেনে ফেলি তার দুর্বিসহ অবিশ্বাস্য জীবনগল্পের পুরোটা। অবিশ্বাস্যভাবেই সে হুট করে তরুণ হতে শুরু করে একদিন। স্ত্রী তাকে অসম্ভব ভালবাসত বলে যখন বুঝতে পারে স্বামী তরুণ হয়ে উঠছে, তখন স্বামীর তারুণ্য ঠেকিয়ে দিতে চেয়ে খাবারে প্রচুর বিষ মেশায়। সে পোষা কুকুরকে মায়াবশত একটুকরো মাংস নিজের খাবারের আগে দিতেই কুকুর সেটা খেয়ে মারা যায় মুহূর্তেই। ধরা পড়ে গ্লানিতে তার বৃদ্ধা স্ত্রী নিজেই বিষ খেয়ে মরে। এক ছেলে তাদের। দুর্বিসহ জীবন কাটাতে থাকে সে আর ছেলে। ততদিনে বিপদ স্পষ্ট টের পায় সে। চেনা-জানা পৃথিবী তাকে স্বস্তি দেবে না এটা বেশ বুঝতে পারে। সেই বুঝতে পারা সত্ত্বেও দু’জন বিজ্ঞানীর খপ্পড়ে পড়ে প্রাণ হারাতে হারাতে বেঁচে ফেরে। ওরা তাকে কেটে-ছিঁড়ে পরীক্ষা করে মানবতার কল্যাণে বিশাল অবদান রাখার স্বপ্ন দেখত। ছেলে, ছেলের পরিবার সাথে নিয়ে ঘনঘন স্থান বদল করে মানুষের আগ্রহের আড়ালে টিকে যেতে সমর্থ হয় সে। কোথাও থিতু হওয়া, শেকড় গেড়ে বসার ভাগ্য সকলের হয়-ও না আসলে। একটা মানুষ, প্রকৃতির আজব খেয়ালে বদলে যাওয়া শরীরের অধিকারী অসহায় মানুষের কী করুণ জীবন! ছেলের বয়স বাড়তে থাকে আর সে ছোট হয়ে আসে। এরপর ছেলে, ছেলের বউ মরে অসুখে ভুগে। তারপর থেকে দুই নাতিকে বড় করে তোলার কঠিন সংগ্রামে কেটে যায় অনেকগুলো দিন। জীবিকার তাগিদে পুনরায় গ্রাজুয়েশন, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে। আমাদের পরিচয়ের সময়েই প্রায় বড় নাতির সমান বয়সে পৌঁছায়। আমাকে জানায়- সে ক্লান্ত। ভীষণ ক্লান্ত। একটা অস্বাভাবিক জীবন টেনে নেবার মত করুণ চেষ্টা আর হয় না। আমাকে নিশ্চিত করে, একদিন গাঢ় প্রেমে আচ্ছন্ন হয়েই হয়তো আমার মনোভাব বদলে যাবে, অস্বাভাবিকতা মানতে চাইব না ঠিক তার প্রয়াত স্ত্রীর মতন…… যদি জানতাম, কী ভীষণ সত্যি সেটা!’ একটু থেমে বলেন, ‘চলো খেয়ে নেয়া যাক। নইলে গল্প শেষ করে উঠে খেতে খেতে খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।’

খাবার সামনে নিয়ে গল্পে পড়ে থাকে মন। কী অদ্ভুত গল্প। কত কিছু ঘটে পৃথিবীতে! নিশ্চয়ই এর কোনো বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা না থেকে পারে না। সেটাই জানতে চাই খাবার শেষে। খালা হাসেন। বোঝেন, গল্পে দারুণ আগ্রহ আমার।

জানান, ‘এটা নিশ্চয়ই জানো, মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে থাকে কোষের বয়সবৃদ্ধি এবং এক পর্যায়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়ায়? কিন্তু কোষ যখন নিজের অনুলিপি তৈরী করতে পারে তবে ধ্বংস হয়ে গেলেও ক্ষতি কী? অনবরত নিজেকে সে ক্লোন বা কপি করেই তো। এখানে আসলে দায়ী কোষের টেলোমেয়ার নামক বস্তু। একে কোষের সময়ঘড়িও বলতে পারো।পাশের ক্রোমোজোমের সাথে মিশে যাওয়া বা ক্রোমোজোমের শেষ প্রান্তের ক্ষয় থেকে এটি ক্রোমোজোমকে বাঁচায়। বা বলতে পারো ক্রোমোজোমের শেষ প্রান্তকে খাটো হতে দিয়ে, টেলোমেয়ার ক্রোমোজোমের শেষ প্রান্তের জিন ক্ষয় রোধ করে। টেলোমেয়ার ছাড়া জিনোমগুলো অনবরত তথ্য হারাত। প্রতিবার বিভাজনের সময়েই কোষগুলো সব ক্রোমোজম টেলোমেয়ারসমেত কপি করে যাতে পরবর্তী কোষটি পূর্ণাঙ্গ একসেট ক্রোমোজম বা ডিএনএ পায়। তবে মানুষের জন্যে দুঃখের বিষয়, এই অনুলিপি প্রক্রিয়ায় প্রতিবার টেলোমেয়ার তার কিছু অংশ হারাতে থাকে। এভাবে টেলোমেয়ার যখন প্রায় শূন্য দৈর্ঘ্যে পৌঁছে যায় তখন আর কোষ রক্ষা পায় না, কোষ বিভাজন থামে এবং কোষেরা মরতে শুরু করে। আর এই কোষের মৃত্যুই হলো আমাদের বুড়িয়ে যাওয়া। যার ফলে আসে মৃত্যু। স্বাভাবিক মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া প্রতিজন মানুষ এই প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে বাধ্য। বিস্ময়করভাবে এর ব্যতিক্রম ঘটানোর উপাদানও আমাদের শরীরে উপস্থিত। সেটা টেলোমারেজ নামের একটি এনজাইম। এই উপাদান, তাত্ত্বিকভাবে, টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্য কমতে দেয় না বা টেলোমেয়ারকে পুর্নগঠন করতে সক্ষম।কিন্তু শরীরের কোষে এটি বন্ধ বা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। যদি কোনো উপায়ে একে জাগ্রত করা যায়, তবে শরীরের কোষগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বিভাজিত হতে থাকবে আর মৃত্যু চলে যাবে অস্বাভাবিক দুরত্বে। তবে আজতক এমনটা ঘটার কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই মানুষের ইতিহাসে। কেবল গলদা চিংড়ির ক্ষেত্রেই বোধহয় এটির ক্রিয়া প্রমাণিত।’

‘এত কিছু জানেন কী করে? চিরযুবক?’

‘না। সব শেষ হবার আগে ওকে নিয়ে জাপান যাই। সেখানের এক ডাক্তার এ-সব জানায়। সে ডাক্তার ব্যাখ্যা করে, ওর টেলোমারেজ চালু হয়ে যাওয়াটাই ওকে ক্রমান্বয়ে তরুণ করে তুলছে। যেখানে কোষের বিভাজন ক্রমেই থেমে যাবার কথা সেখানে ওর কোষগুলো পুরোদমে বিভাজিত হতে শুরু করে একসময়। ওকে দিন দিন করে তোলে তরুণ। আসলে এটা এক মিরাকল। ওর বয়স যখন পয়ষট্টি তখন এক ভয়ানক দুর্ঘটনায় প্রচুর রক্ত নিতে হয় ওকে। প্রায় বছরখানেক অসুস্থ থাকার পর ধীরে ধীরে তার শরীর সজীব হয়ে উঠতে থাকে। সবকিছু বদলে যায়। সেই দুর্ঘটনা না ওই রক্ত না-কী অন্য কোনো কারণে টেলোমারেজ চালু হয়ে তার শরীর ক্রিয়া বদলে দেয় সেটা জানা যায়নি।’

‘অবিশ্বাস্য!’

‘কিন্তু কিছুদিন পর, বিশেষ করে সম্পর্ক গাঢ় হয়ে ওঠার পর চেয়েছি, ওর বয়সের উল্টো ছুটে চলা থেমে যাক।’

‘কেন এমন চাইবেন। এটা অন্যায়!’ চেঁচিয়ে উঠি ভদ্রতাজ্ঞান ভুলে।

খালা কেঁদে ফেলেন মুহূর্তেই। ‘হ্যাঁ সেটা অন্যায়। কিন্তু ওর মৃত স্ত্রীর মানসিক যন্ত্রণাটা উপলব্দি করতে শুরু করি একসময়। মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর। ব্যতিক্রম কী করে হই? সে ক্রমেই তরুণ হতে থাকবে, উল্টো বয়সে ফিরে যাবে- এসব অসহ্য ভাবনা হয়ে খোঁচাতে থাকে। ওর সেই ফিরে যাওয়া মানেই তো হতো ওকে হারানো? আমার তো বুড়ো বয়সেও ওকে দরকার! আমার তখনের মানসিক যন্ত্রণা তোমাদের বোঝাতে পারব না। একদিন ভাবনাটা বলি ওকে। সে সবজান্তা হাসে। বিষণ্নতাও যেন নতুন করে ফোটে চোখে, ঠোঁটে। যেন জানত এমনটাই হবার কথা। শুধু প্রশ্ন করে- তুমিও? তারপর থেকে দূরে সরে থাকতে শুরু করে। কিন্তু আমার মনোযন্ত্রণা, তীব্র হাহাকার, পাগলামী…. অথবা হয়তো আমার অসম্ভব মমতা বা একাগ্র জেদ বা প্রেম ওকে ভেঙে ফেলে। একদিন ফিরে এসে বলে- দীর্ঘসময় পৃথিবী দেখে দেখে ভীষণ ক্লান্তি আমার। নিজেকে তোমার ওপর ছেড়ে দিলাম। আমাকে নিয়ে যা খুশি করতে পারো।’

‘তারপর?’ ফিসফিসিয়ে বলি, যেন জোরে বললেই ভেঙে যাবে গল্পঘোর।

‘আমার হাতে যথেষ্ট পৈত্রিক সম্পত্তি থাকায় ওর চিকিৎসা করাতে টাকার সমস্যায় পড়ব না, এটা জানতাম। এ কারণেও হয়তো মরিয়া হয়ে উঠি। খোঁজ-খবর নিতে শুরু করি। জাপানের এক হাসপাতালের রিসার্চের একটি তথ্য ওর জানা থাকায় আমাকে জানায়। রিসার্চ পেপারটা সংগ্রহ করি। সেই রিসার্চে দাবী করা হয়, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চরম উন্নতির বদৌলতে এবং ন্যানো টেকনোলজির সহায়তায় টেলোমারেজ চালু বা বন্ধ করা সম্ভব। কিছু ছোট প্রাণীর দেহে ওই বিষয়ক পরীক্ষা সফল বলে দাবি করা হয় রিসার্চ পেপারে। হাসপাতালটিতে খোঁজ খবর নিয়ে জানি, ওরা মানুষের শরীরে এখনি এই পরীক্ষা চালাবে না। আরো বছর কয়েক অপেক্ষা করে একদম মৃত্যুপথযাত্রী কারো ওপর পরীক্ষাটা চালাবে। এছাড়াও, প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অপেক্ষা করতে রাজি হই না। নাছোড়বান্দা হয়ে পড়ি, অথবা বলতে পারো উন্মাদ। প্রথমে মনে হতে থাকে ওর স্বাভাবিক জীবন প্রক্রিয়া ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা এক মহৎ উদ্যোগ। যাকে ভালবাসি তার জন্যে এটা করাই যায়। পরে ঠিক বুঝি, কেবল উন্মাদ-স্বার্থপরই বলা চলে আমাকে। আত্মযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আত্মাহুতি দিতে রাজি করিয়ে ফেলি ওকে। একটা পুরোনো জমি বিক্রি করে পাঁচকোটি টাকা যোগাড় করে হাসপাতালটিকে রাজি করাই ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসাটা করতে। যাবার আগে সে ভীষণ অবাক হয়ে একবার বলেও ফেলে- তুমি এত মরিয়া কেন, যদি মারা যাই? উত্তর দিই- নারীর প্রেম এমনই, মরিয়া। পুরুষের বুঝে আসবে না। আর সাথেই আছি তোমার, ভয় পেয়ো না, সব ঠিক হয়ে যাবে…..  প্রায় ন-দশ বছর আগে এক মনোরম সন্ধ্যায় আমরা জাপানের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ি। বাবা-মা-বড় বোন সকলেই মৃত বলে আমাকে অভিভাবকের বাঁধায় পড়তে হয়নি। আহ, যদি বাঁধা দেবার কেউ থাকত!’

আবারো কাঁদতে শুরু করেন। ভয়ানক উথাল-পাথাল কান্না। বউ বিমূঢ় ছলছল চোখে তাকে কেবল জড়িয়ে রাখে, যতক্ষণ না তিনি শান্ত হন। নিশ্চিতভাবেই কারো শোক-তাপে আগ্রহ কখনোই বোধ করিনি। গল্পই চিরকাল মুখ্য আমার কাছে। গল্পে আগ্রহ ঠকঠাক ধরে রেখে জিজ্ঞেস করি, ‘তারপর?’

‘টেলোমারেজ বন্ধের চেষ্টায় বন্ধ হয় ওর হৃদপিন্ড। মৃত্যুর পর ওর লাশ যেন আরো তরুণ আর সজীব হয়ে ওঠে। মৃত্যুতেও সে অদ্ভুত মায়াময় রয়ে যায়… ওটা একপ্রকার খুন। আমার স্বার্থে, আমার ইচ্ছাপূরণে। ওর নাতিরা আমাকেই দোষী করে, খুনি বলে।’ ফের কাঁদেন তিনি।

এবার শোকের উত্তাপ পাই। কঠিন হৃদয় পুুরুষ হয়েও উপলব্দি করি, চোখে জল টলমল। গলায় দলা পাকায় অদ্ভুত কিছু একটা। ভীষণ মমতা, হাহাকার বুকে দাপিয়ে বেড়ায় অদেখা চিরযুবকের জন্যে। নিষ্ফল ক্রোধও। ভালবাসার ফাঁদে ফেলে পৃথিবী এমন কত কত অসাধারণ জীবন কেড়ে নেয়, কে হিসেব রাখে? এছাড়াও, এমন করুণ গল্প কী করে মেনে নেয়া যায়? ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলি, ‘মানুষটার দেখা পেলে ভাল হতো। কী করুণ মানুষ! কবর কোথায় তার?’

‘সে তোমার আমার ধারণার চেয়েও মহৎ। হাসপাতালটির অনুরোধে তাদের গবেষণার সুবিধার্থে দেহ দান করে সে। আমাকে না জানিয়েই। চিকিৎসা শুরুর আগেই ওই দানের ব্যাপারে অনুমতি দিয়ে দেয়। হয়তো জানতো যাত্রার শেষে দাঁড়িয়ে। অথবা এমনও হতে পারে যে, ওটা আমার প্রতি তার সুক্ষ্ম প্রতিশোধ। হয়তো আমার অবুঝপনা, পাগলামীর শাস্তি দিতেই তার কোনো স্মৃতি-কবর যেন আমার নাগালে না থাকে, সে ইচ্ছেতেই দেহ দান করে সে। জাফলংয়ের সেই পিকনিকের একটি গ্রুপ ছবিই ওর একমাত্র স্মৃতি। আর কিছু নেই। দাঁড়াও ছবিটা দেখাই তোমাদের।’

খালা ছবি আনতেই আমরা প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ি। তিনি ম্লান হেসে বলেন, ‘নীল টি-শার্ট ।’

ভাসা ভাসা মেয়েলী চোখের নীল টি-শার্ট পরা ঝকঝকে এক তরুণকে দেখি আমরা গভীর শোকে। সত্যিই বিষণ্ন সে। অপরূপ সে বিষণ্নতা। যেন ঠিক জানতো, খুব শীঘ্রই ছবি হয়ে যাবে। তার পাশের জনই খালা শাশুড়ি। বিস্মিত হই বর্তমান অতীতে হেরফের না দেখে। সন্দেহ হতে থাকে আমার। তিনিও চিরযুবতী নন তো?

গল্প শেষে ছবিটা মোবাইলে তুলে সেদিন খালার ওখানে রাতে থেকে পরদিন বাসায় ফিরেই কম্পিউটারে বসি। অত করুণ, বিষণ্ন একটি গল্প ফেসবুকে পোস্ট করে সকলকে জানানোর তীব্র ইচ্ছে হতে থাকে আমার। চিরযুবকের গ্রুপ ছবি অনেক পুরোনো এবং কিছুটা ঝাপসা। শুধু চিরযুবকের ছবি ক্রপ করে গুগল ইমেজ সার্চে দিই, হয়তো কিছু ঝকঝকে ছবি মিলে যাবে। যদিও ফেসবুক পোস্টের সাথে ছবি দেয়াটা কেমন যেন কুৎসিত মনে হয় আমার। তবে ছবিটা কাজে দেবে কিছু মাত্রায়। চিরযুবকের অপরূপ বিষণ্ন মুখাবয়ব প্রভাবিত করবে পাঠককে, এটা নিশ্চিত। আর এতে করে, এমনও হওয়া সম্ভব যে, আরো বেশি দিন চিরযুবক টিকে যাবে। মুখে মুখে গল্পে গল্পে অনির্দিষ্টকাল চিরযুবাই থেকে যাবে সে। এ-ও এক অমরত্ব হয়তো…

সৌভাগ্যের বিষয়, চিরযুবকের প্রায় ডজনখানেক নানারকম ঝকঝকে ছবি লোড হয়ে স্ক্রীনে ভাসতে থাকে। কিন্তু সবগুলোই বাংলা-ইংরেজি দেশি-বিদেশি বিজ্ঞাপনে সাঁটা। প্রতিটিতেই একই শিরোনাম: “একে ধরিয়ে দিন।”